• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

কোরীয় যুদ্ধের আদ্যেপান্ত

নীলফামারি বার্তা

প্রকাশিত: ১৫ নভেম্বর ২০১৮  

একই সংস্কৃতি, একই ভাষা হওয়া স্বত্তেও কি একটি জাতি আলাদা হতে পারে? শুধু দেশের সীমানার কাঁটাতার দিয়ে আলাদা নয় বরং চিরশত্রু হয়ে? থাকতে পারে কি সর্বদা যুদ্ধকালীন অস্থির অবস্থায়? হ্যাঁ, উত্তর এবং দক্ষিণ কোরিয়ার কথাই বলছি। এরা একই জাতি হওয়া স্বত্তেও ৩৮ প্যারালাল রেখা দিয়ে বিভক্ত। শুধু বিভক্তই নয় বরং একে অপরকে চিরশত্রু হিসেবেও দেখে। প্রায়শই পত্রিকা বা টিভি নিউজে দুই কোরিয়ার অস্থিতিকর অবস্থায় নিদর্শন পাওয়া যায়। তাছাড়াও দুই কোরিয়ার সীমানা ৩৮ প্যারালাল রেখাকে ধরা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদজ্জনক সীমানা হিসেবে। যুদ্ধেও জড়িয়েছিল এই দুই দেশ। যে যুদ্ধ অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। কিন্তু কি কারণে এই জাতির মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল? কেনই বা এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেনি? আর কেনই বা একই জাতির মানুষ হয়েও তারা নিজেদের চিরশত্রু মনে করে?

 

1.কোরীয় যুদ্ধের আদ্যেপান্ত

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে অবিভক্ত কোরিয়া জাপানের একটি কলোনি ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হেরে যাওয়ার পর এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারকারী দুই মিত্রশক্তি জাপানের অধীকৃত সকল অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বিস্তার শুরু করে। এরই রেশ ধরে ১৯৪৫ সালের আগষ্টে মার্কিন স্টেট ডিপার্মেন্ট ৩৮ তম প্যারালাল রেখায় দুই কোরিয়াকে বিভক্ত করে। উত্তরভাগ সোভিয়েত ইউনিয়নের এবং দক্ষিণ ভাগ যুক্তরাষ্ট্রের। দুই পরাশক্তি সেভাবেই দুই কোরিয়ায় প্রভাব বিস্তার তথা নিজেদের মত করে সাজাতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন উত্তর কোরিয়ায় সমাজতন্ত্র চালু করেন এবং কমিউনিস্ট নেতা কিম জং সুং এর হাতে শাসনভার তুলে দেন।

 

2.কোরীয় যুদ্ধের আদ্যেপান্ত

অপরদিকে দক্ষিণ ভাগে মার্কিন আরেক স্বৈরশাসক সুইংমান রিহ এর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। কিন্তু এই দুই স্বৈরশাসক নিজেদের সীমানা নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তারা দু’জনই অপরপক্ষে সীমানা বিস্তার করার চিন্তায় মত্ত ছিলেন। এ কারণে সেই শুরু থেকেই দুই কোরিয়ার সীমানা উত্তপ্ত ছিল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বেই কোরিয়ান সীমানা তথা ৩৮ তম প্যারালাল রেখায় সীমানার লড়াইয়ে দুই পক্ষের সম্মিলিত প্রায় ১০ হাজার সৈন্য প্রাণ হারান। এই যুদ্ধ মনোভাব সীমানা থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পরে। এই অবস্থা প্রায় ৫ বছর চলে। পরবর্তীতে, ১৯৫০ সালের ২৫ জুন উত্তর কোরিয়ার ৭৫ হাজার সৈন্য ৩৮ তম প্যারালাল রেখা অতিক্রম করে দক্ষিণ কোরিয়ার উপর আগ্রাসন শুরু করে। হতোচকিত দক্ষিণ কোরিয়ার সৈন্যরা কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই উত্তর কোরিয়ার সৈন্যরা একের পর এক দক্ষিণ কোরিয়ান অঞ্চল দখল করতে থাকে। এভাবেই শুরু হয় দুই কোরিয়ার শত্রুতা তথা যুদ্ধ। কিন্তু কেমন ছিল এই যুদ্ধ?

 

3.কোরীয় যুদ্ধের আদ্যেপান্ত

কোরীয় যুদ্ধের স্থায়ীত্ব ছিল ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত। এই যুদ্ধের স্থায়ীত্ব কম হলেও কোরীয় যুদ্ধ আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত। কোরীয় যুদ্ধে প্রায় ৫ মিলিয়ন মানুষ প্রাণ হারান। যার মধ্যে বেশিরভাগই ছিল নারী ও শিশু। এক সমীক্ষায় জানা যায়, কোরীয়ান যুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রাণ হারানোর হার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে বেশি ছিল। এছাড়াও প্রাণ হারায় প্রায় ৪০ হাজার মার্কিন সৈন্য। কোরীয় যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল স্নায়ু যুদ্ধের শুরুর দিকে। এই যুদ্ধ মূলত দুই পরাশক্তির জন্য একটি প্রক্সি ওয়ার ছিল। মার্কিন তথা পশ্চিমা কূটনীতিবিদরা মনে করেছিল, কোরীয় যুদ্ধ ছিল সোভিয়েত আগ্রাসনের প্রথম ধাপ। ধীরে ধীরে কমিউনিষ্টরা পুরো পৃথিবী দখল করবেন। একারণেই কোরীয় যুদ্ধকে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হিসেবেও ধারণা করা হয়েছিল। উত্তর কোরিয়ার সৈন্যরা দক্ষিণের রাজধানী সিউল পর্যন্ত পৌছানোর পূর্বেই মার্কিন কমিউনিষ্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা তথা দক্ষিণ কোরিয়ায় সৈন্য প্রেরণ করেছিলেন। কোরিয়ায় মার্কিনরা প্রথম প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ কৌশল শুরু করে। কিন্তু এই কৌশল তেমন কাজে দেয় না। কারণ বেশিরভাগ দক্ষিণ কোরীয় সৈন্যই ছিল ভীত। যুদ্ধক্ষেত্রে খারাপ পরিস্থিতি দেখলে ভীত সৈন্যরা পালিয়ে যেত।

 

4.কোরীয় যুদ্ধের আদ্যেপান্ত

অপরদিকে, উত্তর কোরীয় সৈন্যরা ছিল ডিসিপ্লিন্ড এবং আধুনিক সব সোভিয়েত অস্ত্রসস্ত্রে পারদর্শী। প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ কৌশলে সফল না হলে এশিয়ার ভারপ্রাপ্ত মার্কিন জেনারেল ডগলাস ম্যাকওর্থার অগ্রাসন নীতি অনুসরণ করেন। তিনি নতুন নীতি ঠিক করেন, শুধুমাত্র দক্ষিণ কোরিয়া নয় বরং উত্তর কোরিয়া থেকেও কমিউনিষ্টদের দূর করবেন। এজন্য মার্কিন এবং দক্ষিণ কোরীয় মিলিত সৈন্যবাহিনী তাদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করেন। এই কৌশল কাজে দেয় এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যেই উত্তর কোরীয় সৈন্যদের সিউল থেকে বের করে ৩৮ প্যারালালের ওপারে পাঠায়। কিন্তু এতেই থেমে থাকেনি মার্কিন সৈন্যরা। তারা ৩৮ প্যারালাল রেখা অতিক্রম করে একের পর এক উত্তর কোরিয়া এলাকা দখল করতে থাকে। অবশেষে উত্তর কোরীয় সৈন্যদের চায়নার বর্ডারে ইয়ালু নদীর তীরে কোণঠাসা করে ফেলে। চাইনিজ বর্ডারের পাশে যুদ্ধ চলার কারণে কমিউনিষ্ট চাইনীজরা এই যুদ্ধকে তাদের নিজেদের জন্য হুমকি মনে করে এবং তৎকালীন চাইনীজ নেতা মাও সেদং যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে হুমকি দেন।

 

5.কোরীয় যুদ্ধের আদ্যেপান্ত

কিন্তু থেমে থাকেনি মার্কিন তথা দক্ষিণ কোরীয় সৈন্যরা। যে কারণে চাইনিজরাও যুদ্ধে যোগ দেয়। এই সমস্যা সমাধানে ১৯৫১ সালে চাইনীজ এবং মার্কিন অথোরিটি জাতিসংঘে মিলিত হয়। কিন্তু সমাধান সভা চলা অবস্থায় যুদ্ধ পুরোদমেই চলতে থাকে। তবে কি ছিল এর সমাধান? কোরীয় যুদ্ধের কোনো সঠিক সমাধান আজও হয়নি। মার্কিন এবং অন্যান্য অথোরিটি দুই বছর ধরে যুদ্ধ বন্ধের জন্য কথাবার্তা চালায়। কিন্তু এর কোনো সমাধান হয়নি। অবশেষে ১৯৫৩ সালে যুদ্ধ বিরতির চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুয়ায়ী, দক্ষিণ কোরিয়া প্রায় ১ হাজার ৫০০ বর্গমাইল নতুন সীমানা লাভ করে এবং দুই কোরিয়ার মধ্যবর্তী ৩৮ প্যারালাল রেখাকে ডিমিলিটা্রাইজড জোন হিসেবে ঘোষণা করে ২ কি.মি. চওড়া এলাকা জুড়ে সীমানা নির্ধারণ করা হয়। ৩৮ প্যারালাল রেখায় এখনো দুই কোরিয়ার সৈন্যরা যুদ্ধাবস্থায়ই অবস্থান করে। দুই কোরিয়ার মধ্যকার যুদ্ধের কোনো সমাধান না হওয়ায় প্রায় ৬৫ বছর ধরেই দেশ দুটোর মধ্যে অস্থিরাবস্থা বিরাজ করছে।