• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

সর্বশেষ:
বাংলাদেশকে হুমকির মুখে ফেলেছে ক্রমবর্ধমান জলরাশি: গবেষণা উত্তরবঙ্গের মহাসড়কে চার লেন চালু, ঈদযাত্রা হবে স্বস্তির সব উন্নয়ন সহযোগীদের এক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী বিডিএস ভূমি ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে: ভূমিমন্ত্রী বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা দিতে হবে: ওবায়দুল কাদের

জীবনে দাওয়াত ও তাবলিগের গুরুত্ব

– নীলফামারি বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১১ জানুয়ারি ২০২০  

আমাদের জীবনে তাবলিগের সুফল কী হচ্ছে তা নতুনভাবে বলার দরকার নেই। এই নীরব হাতিয়ার ব্যবহার করেই পূর্বেকার মুসলমানরা দেশের পর দেশ জয় করেছিলো।  দাওয়াত ও তাবলিগের গুরুত্ব, জীবন পরিবর্তন এর কার্যকারিতা প্রতিষ্ঠিত একটি বিষয়। 
দিগ্বিজয়ী বহু জ্ঞানী, যুদ্ধা ও রাষ্ট্র নায়ক ইসলামের সামনে মাথা নত করেছিলো এই হাতিয়ার ব্যবহারের ফলেই। মুসলমানরা বর্তমানে 

যেভাবে শুরু হয়েছিলো দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ: ওহি নাজিল হয়েছিলো গারে হেরায়। যে দিন ওহি নাজিল হয়, ওই দিন সন্ধ্যায়  হজরত খাদিজা (রা.)-কে রাসূল (সা.) ঈমানের দাওয়াত দেন। তিনি ঈমান গ্রহণ করে। হজরত আলী (রা.) তখন রাসূল (সা.) এর তত্বাবধানে বড় হচ্ছিলেন। এক বর্ণনায় পাওয়া যায়, একবার মক্কায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। নবী (সা.) ও তার চাচা আব্বাস (রা.) চাইলেন, আবু তালেবের ওপর থেকে কিছুটা চাপ কমাতে। তাই তারা দু’জন আবু তালেবের দু’সন্তানকে লালন-পালনের জন্য নিয়ে আসেন। রাসূল (সা.) তাকেও দাওয়াত দেন। কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে তখন হজরত আলী স্বীয় পিতা আবু তালেবের সঙ্গে পরামর্শ ব্যতিরেকে ঈমান আনতে অস্বীকার করেন। রাসূল (সা.) তাকে বলেন, তুমি ঈমান আনো আর না আনো কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তুমি আমার এই দাওয়াতের কথা কাউকে বলতে পারবে না। হজরত আলী পিতার সঙ্গে পরামর্শ করেননি এবং পরদিন এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। কোনো কোনো বর্ণনা মতে হজরত আলী (রা.) এই ঘটনার এক বছর পর ঈমান গ্রহণ করেন। তারপর দাওয়াত দেয়া হয় রাসূল (সা.) এর গোলাম যায়েদ ইবনে হারেসাকে। তিনিও ইসলাম গ্রহণ করেন।

এতদিন যারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন তারা ছিলেন রাসূল (সা.) এর পরিবারের সদস্য। এরপর রাসূল (সা.) পরিকল্পনা করলেন, নিজের বন্ধুদের কাছে দাওয়াত পৌঁছাতে। হজরত আবু বকর ছিলেন রাসূল (সা.) এর খুব কাছের মানুষ। তাই তাকে দাওয়াত দেয়া হলো। তিনি তাৎক্ষণিক ইসলাম গ্রহণ করলেন। বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে, যারা মুসলমান হয়েছিলো তারা সামান্য হলেও ঈমান আনয়নে কালক্ষেপন করেছে। কিন্তু হজরত আবু বকর কোনো কালক্ষেপণ করেননি। তাই তিনি উম্মতের মধ্যে সিদ্দিক উপাধিতে ভূষিত হতে পেরেছিলেন। এই পর্যন্ত যারা মুসলমান হয়েছেন আবু বকর ছাড়া বাকি অন্যরা রাসূল (সা.) এর অধীনের লোক। লোকদের সঙ্গে তাদের মেলামেশা কম ছিলো। কিন্তু হজরত আবু বকর ছিলেন বাইরের লোক। তিনি ছিলেন ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক থাকে বেশি। হজরত আবু বকর (রা.) এর কাছে লোকেরা আসতো আর তিনি তাদেরকে দ্বীনের দাওয়াত দিতেন। তার তৎপরতার কারণে অল্প সময়ের ব্যবধানে হজরত ওসমান, আব্দুর রহমান ইবনে আউফ, তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ, সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস, জুবাইর ইবনে আওয়াম ইসলাম গ্রহণ করেন। তারা ছিলেন কুরাইশদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি।  

দাওয়াত ও তাবলিগে দু’টি ধারার সৃষ্টি: রাসূল (সা.) এর যুগ থেকে দাওয়াতি কাজের যে ধারা চালু হয়েছিলো, তা ছিলো অমুসলিমদের কাছে ইসলামের দাওয়াত। সাহাবায়ে কেরাম, নিজেদের পরিচিত অমুসলিম আত্মীয়-স্বজনদের কাছে দাওয়াতি কাজ পরিচালনা করতো। সাহাবায়ে কেরাম ব্যবসার উদ্দেশে বিভিন্ন অমুসলিম এলাকায় যাতায়াত করতো, সেখানকার অমুসলিমদেরকে দাওয়াত দিতো। সাহাবায়ে কেরামের পরের যুগকে বলা হয় তাবেয়ীদের যুগ। হজরত উসমান (রা.) এর শাহাদাতের পরেই মুসলিম বিশ্বে বিভিন্ন রকম অনৈতিক কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে পড়ে। সাহাবায়ে কেরামের পরে তা আরো ব্যাপকতা লাভ করে। তখন মুসলিম আলেম উলামাদের মধ্য থেকে একটি দল তৈরি হলো, যারা মুসলমানদের মাঝে ছড়িয়ে পড়া অনৈতিকতাকে দূর করার জন্য বিভিন্ন সংস্কার মূলক দাওয়াতি কাজ শুরু করলো। এই ধারার কাজও দ্বীনের দাওয়াতের অন্তর্ভূক্ত। তবে আগের ধারা ছিলো অমুসলিমদের মাঝে দাওয়াত আর এই ধারার কাজ হচ্ছে মুসলমানদের মাঝে দাওয়াত। প্রসিদ্ধ তাবী হজরত হাসান বসরী (রাহ.) মুসলমানদের মাঝে সংস্কারের উদ্দেশ্যে দাওয়াতি নানা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছিলো। যুগে যুগে মুসলমানদের মধ্য থেকে যারা বিপথগামী হয়ে ইসলামের মাঝে বিভিন্ন অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড প্রবেশ করাতো এই সকল দায়ীদের দ্বারা তার সংস্কার হতো।

দাওয়াত ও তাবলিগের কাজে সূফিয়ানে কেরামের ভূমিকা: দাওয়াত ও তাবলিগের উভয় ধারায় সূফিগণের অবদান ছিলো অনেক বেশি। আব্দুল কাদের জিলানি, ইমাম গাজালি, মুজাদ্দিদে আলফে সানি (রাহ.) মুসলমানদের সংস্কারে অনেক দাওয়াতি কাজ করেছেন। ওয়াজ ও নসিহত, বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি দ্বারা তারা দাওয়াতি কাজ করেছেন। মোল্লাহ জালাল, নেজামুদ্দিন আউলিয়া, বাবা আদম শহীদ (রাহ.)-সহ আরো অনেকে অমুসলিমদের মাঝে দ্বীন প্রচারে ব্যস্ত ছিলেন। উপমহাদেশে ইসলামি সেনাপতিদের বিজয়াভিযান পরিচালনার আগেই দাওয়াতি কর্মকাণ্ড পরিচালনা দ্বারা সূফিগণ বহু এলাকা ইসলামের ছায়ায় নিয়ে এসেছিলেন। এমনকী বিজয় হওয়ার পরও সেনাপতিরা, সূফিগণের দ্বারা ইসলামের দাওয়াতের কাজ অব্যাহত রাখেন। ইন্দোনেশিয়া, মালেশিয়া, ফিলিপাইনে ইসলাম প্রচারের কাজ সূফি ব্যবসায়ীদের দ্বারাই হয়েছে।

বর্তমান সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দাওয়াতের অবদান- 

(এক) দ্বীনি বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি : মুসলমানরা দ্বীন থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে, দ্বীনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিধিবিধানকে অবহেলা করা হতো। দ্বীনকে বদ্বীন মনে করে ছেড়ে দেয়া, কুসংস্কার ও কুপ্রথাকে দ্বীন মনে করে পালন করা ছিলো সাধারণ ব্যাপার। দাওয়াত ও তাবলিগের মেহনতের বদৌলতে মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি হয়েছে। এখন কোনো কাজ করার আগে বিজ্ঞ মূফতীর কাছ থেকে জেনে নেয়ার প্রয়োজন অনুভব করেন অনেকে। এই সচেতনতা এসেছে মূলত বিভিন্ন দাওয়াতি কাজের মাধ্যমে

(দুই) ইসলামি সংস্কৃতি ও তাহজিব তামাদ্দুন রক্ষা: পাশ্চাত্যের দেশগুলো মুসলিম বিশ্বে উপনিবেশ স্থাপন করে তারা শুধু ব্যবসা বাণিজ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। বরং মুসলিম বিশ্বে পাশ্চাত্যের সভ্যতা-সংস্কৃতিও চালু করেছে। পশ্চিমা সভ্যতা সংস্কৃতির আগ্রাসনে যখন ইসলামি সভ্যতা সংস্কৃতি নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে তখন বিভিন্ন দাওয়াতি কর্মকাণ্ড দ্বারা ইসলামি সংস্কৃতি ও সভ্যতার পুনরূত্থান ঘটেছে। বর্তমানে যুব সমাজের মাঝেও এ ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকে পাশ্চাত্যের নোংরা সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নিচ্ছে।

সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষায় দাওয়াতি কাজের অবদান: বর্তমান সময়ে যখন সব দিকে অস্থিরতা বিরাজমান, এক দিকের অশান্তি বন্ধ করার আগেই অন্য দিকে অশান্তির হাওয়া চালু হয়ে যায় এই মুহূর্তে মানুষকে স্বস্তি এনে দিচ্ছে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ। পিতা-মাতা যখন সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন হচ্ছেন তখন তাকে মানুষ করার জন্য আশ্রয় নিচ্ছেন দাওয়াত ও তাবলিগের । আমাদের সমাজে মাদকের ব্যাপকতা ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। উঠতি বয়সের ছেলে মেয়ে থেকে নিয়ে বহু মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। কিন্তু এই রোগ থেকেও নিরাময়ের জন্য বহু পিতা-মাতা তাবলিগের রাস্তাকে বেছে নিচ্ছেন। ছেলে মেয়ের অনৈতিক সম্পর্ক, সামাজিক অনৈতিক কার্যকলাপ থেকে বাঁচানোর জন্যও তাবলিগকে বেছে নিতে হয়েছে অনেক পিতা-মাতার।

অর্থনৈতিক স্বচ্ছতায় তাবলিগের অবদান: সামাজিক শৃঙ্খলার সঙ্গে লেনদেন ও অর্থনৈতিক বিষয়ের স্বচ্ছতার প্রসঙ্গটিও আসতে পারে। তাবলিগে গিয়ে বহু মানুষ নিজের অতিতের লেনদেনে অস্বচ্ছতার ওপর অনুতপ্ত হয়েছেন। সুদ হিসেবে মানুষের কাছ থেকে যে টাকা নিয়েছেন, তাবলিগ থেকে ফিরে এসে সে টাকা ফেরত দিয়ে এসেছেন। ওজনে কম দেয়া, ব্যবসায় ঠকানো, চাকরিতে অবহেলা করে মালিকের ক্ষতি করা থেকে বিরত হয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যাও নেহায়াত কম হবে না। 

শিক্ষা ক্ষেত্রে তাবলিগের অবদান: তাবলিগের বদৌলতে শিক্ষা ক্ষেত্রেও উন্নয়ন হয়েছে। সাধারণ একজন মানুষ তাবলিগে সময় দিলে তার মাঝে ভদ্রতার একটা ছাপ পরিলক্ষিত হয়। শিক্ষার উদ্দেশ হচ্ছে আদর্শ মানুষ হওয়া। সে কাজটুকু সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে তাবলিগ দ্বারা অনেকটা হয়ে যায়। দায়িত্বশীল হিসেবে গড়ে তোলাও শিক্ষার একটা উদ্দেশ্য। সমাজে এমন অসংখ্য যুবক পাওয়া যাবে যারা তাবলিগের বদৌলতে পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল হয়েছে। তাছাড়া দ্বীনি শিক্ষা, কোরআন ও হাদিসের প্রাথমিক শিক্ষা একজন মানুষ তাবলিগ থেকে হাসিল করতে পারে। তাই তাবলিগকে বয়স্কদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বললেও ভুল হবে না।

কোরআন ও হাদিসে অসংখ্য জায়গায় তাবলিগের তাকিদ দেয়া হয়েছে। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কাছে আমার পক্ষ থেকে একটি আয়াত পৌঁছলেও তা মানুষের কাছে পৌঁছে দাও।’ অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালা ওই লোকের চেহারাকে সবুজ তাজা করে দেন, যে আমার পক্ষ থেকে কনো হাদিস শুনে অতঃপর তা যেমনভাবে শুনেছে তেমনিভাবে অন্যের নিকট পৌঁছে দেয়।’ হজরত আলীকে বলেছেন, ‘তোমার দাওয়াতে একজন মুসলমান হওয়া তোমার জন্য লাল উট লাভ করার চেয়ে উত্তম।’ তিরমিজির শরিফে একটি হাদিস উল্লেখ হয়েছে, তাতে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘দাওয়াত ও তাবলিগ মুসলমানদেরকে অন্যদের থেকে সুরক্ষা দেবে।’ তেমনিভাবে আল কোরআনে তাবলিগের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি ভীতি প্রদর্শনকারী ও সুসংবাদদাতা হিসেবে’। অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘হে নবী! আপনার কাছে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তা আপনি মানুষের কাছে পৌঁছে দিন।’

সীরাতের কিতাব সমূহে নবী করিম (সা.) এর দাওয়াতি মেহনত ও সাহাবায়ে কেরামের কোরবানির কথা উল্লেখ আছে। অথচ অন্যান্য সম্প্রদায় নিজেদের ধর্মের দাওয়াত দেয়ার জন্য সারা দুনিয়ায় চষে বেড়াচ্ছে। আর মুসলমানরা এ ব্যাপারে উদাসীন। উম্মতে মুসলিমা যদি যথাযথভাবে দাওয়াতের মাধ্যমে অন্যদের কাছে ইসলাম না পৌঁছায় তাহলে আল্লাহ তায়ালার কাছে এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে। ইতিহাস সাক্ষী, তাতারি বর্বর জাতিকে কোনো শক্তি দিয়েই দমন করা সম্ভব হয়নি। অবশেষে দাওয়াতের দ্বারা তারা ইসলামের চরম দুশমন থেকে পরম বন্ধুতে রূপান্তরিত হয়েছিলো। আজকেও আমরা যদি দাওয়াতের ময়দানে নেমে যাই তাহলে ইসলামের চরম বিদ্বেষীরাও একদিন ইসলামের ছায়াতলে এসে আশ্রয় নিবে-ইনশাল্লাহ!