• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

সর্বশেষ:
ছয়দিনের সফরে ব্যাংককে পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী গরমে ‘অতি উচ্চ ঝুঁকিতে’ বাংলাদেশের শিশুরা: ইউনিসেফ গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা: বেরোবি কেন্দ্রের পরীক্ষার্থী ৩১ হাজার ৯৪৬ জন বাংলাদেশ-ভারত ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে: ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী কাতারের আমিরের সফরে যা পেল বাংলাদেশ

পুরস্কার! বড্ড অপরিষ্কার 

– নীলফামারি বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০  

অনেকদিন ধরে ‘পুরস্কার’ নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে এটা বেড়েছে।  বেড়েছে কারণ একের পর এক অযোগ্য লোকের হাতে পুরস্কার চলে যাচ্ছে। যে সে পুরস্কার নয়, বাংলা একাডেমি, একুশে, এমনকি স্বাধীনতা পদকের মতো সর্ব্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারও।
আগে শর্ষিনার পীর সাহেবের পুরস্কারপ্রাপ্তি নিয়ে কথা হতো। কথা হতো একজন নারী কবির একুশে পদকপ্রাপ্তি নিয়ে যিনি একজন মন্ত্রীর স্ত্রী ছিলেন। এখন কথা হয় প্রতিনিয়ত। এখন যোগ্য লোকের হাতে পদক যাচ্ছে না।  অযোগ্যরা পাবার পাল্লা ক্রমশ বাড়ছে।

আগে এত কথা না হওয়া বা জানাজানি না হওয়ার একটা  প্রধান কারণ, তখন ফেসবুক ছিল না। তাই যিনি কখনোই শিশুসাহিত্য করেননি তাকে শিশুসাহিত্যে বা যিনি কখনও গবেষণা করেননি তাকে গবেষণায় পুরস্কার দিলে দু’একদিন একটু ফিসফাস হয়ে মিলিয়ে যেত। প্রযুক্তি এত উন্নত ছিল না। এখন প্রযুক্তি হয়েছে কারো কারো জন্য সর্বনাশা! হাড়ির খবর, নাড়ির খবর সবই টেনে বের করে ফেলে। পার্সোনাল বা সিক্রেট বলে আর কিছুটি রাখার জো নেই।

যা বলছিলাম, হালে দু’দুটি পুরস্কার প্রদান নিয়ে লেখক মহল সোচ্চার। এর একটি একুশে অন্যটি স্বাধীনতা। বাংলা একাডেমি পদক নিয়েও কিঞ্চিৎ কথাবার্তা হয়েছে, তবে তা তেমন জোরালো নয়। জোর পায় একজন প্রয়াত প্রবাসী লেখকের স্ত্রীকে একুশে দেয়া হলে। আগে তাকে তেমন দেখিনি। কয়েক বছর ধরে দেখছি। ফেইসবুকে দেখলাম একজন লিখেছেন, ‘যোগ্য লোককে দেয়া হয়েছে।’ ওনার নাকি অনেক ভালো ভালো লেখা, অনেক মানসম্পন্ন অনুবাদ আছে। হতে পারে। আমি মোটামুটি পড়াশুনা করি। আমি পড়িনি, সেভাবে জানিও না। এটা আমার অযোগ্যতা। কিন্তু ফেইসবুকে একটা পোস্টে  দেখলাম কয়েকজন যুবক দল বেধে দাঁড়িয়ে সাহিত্যে একুশে পদকপ্রাপ্তদের নাম বলছে আর হা হা করে অট্টহাসি হাসছে। দেখে লজ্জায় আমি কুঁকড়ে গেছি। আমি সত্যিই বুঝিনি ওরা এমন করছে কেন! ওরা তো এ যুগের ছেলে। বেশ খোঁজ-খবর রাখে। পড়াশুনা করে। ওরাও কি কিছু জানে না!

যাহোক- আলোচনা তুঙ্গে ওঠে সাহিত্যে স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তির নাম ঘোষণা হবার পর। বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান যিনি একজন লোক গবেষক এবং পন্ডিত ব্যক্তি হিসেবে সর্বমহলে স্বীকৃত তিনি লেখেন, ‘এবার সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার পেলেন রইজউদ্দীন। ইনি কে। চিনি নাতো। নিতাই দাসই বা কে! হায়! স্বাধীনতা পুরস্কার!’ অনেকেই লিখছিলেন। কিন্তু অন্য সবার লেখা আর ওনার লেখা তো এক নয়। একদিন পর বাংলাদেশ প্রতিদিন এ খবর প্রথম পাতায় ছাপে তার ছবিসহ। সেখানেও তিনি বলেন, সত্যিই চিনি নাতো।
 
দেশের সব লেখককে যে উনি চিনবেন তাও নয়। উনি হয়ত আমাকেও চেনেন না। হয়ত বর্তমান মহাপরিচালকও আমাকে চেনেন না। অনেকে চেনাতে চায়, অনেকে চায় না। অনেকে আবার চিনেও চেনে না। কথা হচ্ছে ব্যক্তিকে চেনানো না, কাজ চেনানো জরুরি। আরজ আলী মাতুব্বরকে ক’জন চিনত আবিষ্কার হবার আগে। কিন্তু যখন তাকে চিনল তখন সবাই তাকে, তার কর্মকে না চেনার জন্য নিজেকে ধিক্কার দিতে শুরু করল। শহীদুল জহিরকে ক’জন চিনত? তেমন লেখকও হয়ত আছেন কোথাও কোথাও। তাছাড়া ঢাকা নিয়ে তো পুরো বাংলাদেশ নয়। ঢাকার বাইরে থাকেন, লিটলম্যাগ করেন এমন অনেক ভালো লেখক আছেন। নিজেদের চেনানোর তাদের কোনো চেষ্টা নেই। আবার এমনও দেখেছি চেনেন ঠিকই কিন্তু সেটা স্বীকার  করতে চান না, যদি দাম কমে যায়। আবার যখন সময় খারাপ যায় তখন ঠিকই চেনেন।

যা বলছিলাম- সাহিত্যে যিনি স্বাধীনতা পদক পেলেন তাকে আমরা নাইই চিনতে পারি। কিংবা একুশে পেলেন তাকেও আমরা নাইই চিনতে পারি। কিন্তু কেউ কেউ তো তাকে/ তাদের চিনবে। তার/ তাদের লেখার তো কিছু পাঠক থাকবে। আর শুধু লিখলেই তো হবে না সে লেখা ওই পুরস্কার পাবার মানের হতে হবে। একখানা জেলার ইতিহাস বা দু চারখানা ভুলভাল কবিতা লিখে নিজের পয়সায় নিজের নামে ছাপিয়ে দিলে সে লেখক হয় না। আর যে লেখক হয়না সে একুশে বা স্বাধীনতা পদক পায় কী করে! কারা দেয়, কীভাবে দেয়? নির্বাচক কমিটিতে যারা আছেন তাদের মধ্যে সত্যিকার লেখক ক’জন, ক’জন তেলবাজি পছন্দ করেন সেটা দেখার বিষয়।

এ লেখা লিখতে বা এ কথা বলতে অনেকেই সাহস করবে না পুরস্কারটা হাতছাড়া হয়ে যাবার ভয়ে। কর্তাব্যক্তিরা নাখোশ হবার ভয়ে। হ্যাঁ, ঝুঁকি তো কিছু আছেই। এদেশের লোক সবকিছুই পার্সোনালি নেয়। অদ্ভুত এক সংস্কৃতি হয়েছে। পুরস্কার প্রদানের সঙ্গে জড়িত বড় বড় কর্তাব্যক্তিরা ঢাকা ক্লাবে লেখকের দেয়া পার্টিতে যাচ্ছেন। খানা হচ্ছে, পিনাও হচ্ছে। এরপর ওই লেখক পুরস্কার পাচ্ছেন। বা কোনো লেখকের বাড়িতে ভুরিভোজ করছেন তারপরই ওই লেখক পুরস্কার পাচ্ছেন। আরো অনেক কথা শোনা যায়। বলতে লাজে মরে যাই।

যারা পুরস্কার প্রদানের সঙ্গে জড়িত তারাও তো মানুষ। তাদেরও সমাজ সামাজিকতা আছে, আত্মীয়-স্বজন আছে। আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে লেখকও থাকতে পারেন। নিশ্চয়ই যাবেন, বিয়ে বাড়িতে যাবেন, জন্মদিনে যাবেন। কিন্তু নিছক খাওয়া দাওয়ার পার্টিতে কেন? আর তারপরই পুরস্কার  কেন?

আগে বাংলা একাডেমি পুরস্কার বলতে মানুষ একটা পুরস্কারই বুঝত। এখন সেখানে হাজাররকম পুরস্কার। কোনো একজন বিখ্যাত লোকের পরিবার টাকা দিলেই কেন বাংলা একাডেমি থেকে তার নামে পুরস্কার প্রবর্তন করতে হবে। এই পুরস্কারগুলো তো কোনো একটা ফাউন্ডেশনের ব্যানারেও হতে পারে। গত বছরের কথা। আমাকে একজন চ্যালেঞ্জ করল। বলল, বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেয়া হয়ে গেছে। আমি বললাম, না হতে পারে না। পরে দেখলাম তার কোনো ভুল নেই। বাংলা একাডেমি ঘোষিত বিভিন্ন ব্যক্তির নামে পুরস্কারের ঘোষণা সে শুনেছে। এই ধরনের পুরস্কার প্রবর্তন করায় এই বিভ্রান্তি ঘটছে। বাংলা একাডেমিকে আমরা রাখতে চেয়েছিলাম সব বিতর্কের উর্দ্ধে । তা আর হলো কই!

এবার ফিরে আসি শুরুর কথায়। একাডেমি, একুশে বা স্বাধীনতা পদকের নাম প্রস্তাবক থাকেন। পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা নাম প্রস্তাব করতে পারেন। একুশে আর স্বাধীনতা পদকের ক্ষেত্রে পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছাড়াও নাম প্রস্তাব করতে পারেন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ও জনপ্রতিনিধিরা। প্রস্তাব পাঠাতে হয় নির্ধারিত ফর্মে। একুশের ক্ষেত্রে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় আর স্বাধীনতা পদকের ক্ষেত্রে মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ অনেকগুলো কমিটি পার হয়ে পদকের চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। আমার কথা হচ্ছে, এই প্রস্তাবক কে বা কারা সেটা জানা জাতির জন্য খুবই জরুরি। আর এটাও জানা জরুরি ফর্মে যে তথ্য দেয়া হয়েছে সেগুলো কি? কারণ সাহিত্যে ন্যূনতম অবদান না থাকলে যত তদবিরবাজই হোক কারো তো পুরস্কার পাবার কথা না। কোন তথ্যে কনভিন্সড হয়ে স্বাধীনতা পদকের মতো এতো বড় একটা পুরস্কার দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন নির্বাচকরা জানতে ইচ্ছে করে। নাকি আসলেই ওনার যোগ্যতা আছে এ পদক পাওয়ার? রকমারিতে হয়ত তার বই দেয়া হয়নি। তাই পাওয়া যাচ্ছে না। বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরকে দেয়া একটা সাক্ষাৎকারে তিনি ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, তার ২৫টা বই আছে। এ পুরস্কারপ্রাপ্তির আগে তিনি জানতেন না। পুরস্কারপ্রাপ্তিতে তিনি অভিভুত। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি এটাও জানিয়েছেন, তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। এটাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় অহংকার। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধকালে তার বয়স ছিল ১১ বছর। আর এ বিষয়টি নিয়েও ইতোমধ্যে যথেষ্ট বিতর্কের অবতারণা হয়েছে। তিনি হয়ত ২৫টা বই লিখেছেন। তবে ফেইসবুকে তার যে কবিতা ভেসে বেড়াচ্ছে তা আর যারই হোক কোনো স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকের এটা ভাবতে সত্যিই কষ্ট হচ্ছে।  

একথা ঠিক, মুষ্টিমেয় দু’চারজন বাদে যেই পুরস্কার পায় তাকে নিয়েই আলোচনা সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। এটা বাঙালির স্বভাব। কাজেই যোগ্য ব্যক্তি পুরস্কার পেলেও তাকে কিছুটা ঝড় সামলানোর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। কিন্তু তিনি তো অন্তত জানবেন তিনি যোগ্য। রকমারিতে সার্চ দিলে তার দু চারখানা বই-এর খোঁজ পাওয়া যাবে। ভালো হোক বা মন্দ। দেশের আনাচে কানাচে তার অন্তত দু চারজন পাঠক থাকবে।

আমার এ লেখা কোনো ব্যক্তিবিশেষের পক্ষে বা বিপক্ষে নয়। দীর্ঘদিন সাহিত্য করছি, লিখতে পড়তে ভালবাসি। তাই বড্ড কষ্ট হচ্ছে এসব দেখে। যোগ্য ব্যক্তি পুরস্কার পাক অথবা বন্ধ হোক এই জাতীয় পুরস্কার প্রদান এটাই আমার চাওয়া। তাতে অন্তত লেখকদের দৌড়ঝাঁপ, উপহার আদান প্রদান, ঘোরাফিরা কিছুটা কমবে। একদল ভাবছেন তার চেয়ে খারাপ লেখক পুরস্কার পেয়ে গেছে, কাজেই দে দৌড়। বয়সের কথা ভাবছেন না, সম্মানের কথা ভাবছেন না, দৌড়াচ্ছেন। যেখানে যাওয়া উচিত সেখানেও যাচ্ছেন যেখানে যাওয়া উচিত না সেখানেও যাচ্ছেন। আর একদল ভাবছেন, সিনিয়র হয়েছে তাতে কি বয়স কি পুরস্কার দেয়ার মাপকাঠি । সময় থাকতে নিয়ে নি। তিনিও দৌড়াচ্ছেন। লেখা ভালো করা নিয়ে দু’দলের কেউ ভাবছেন না।

আর যত্রতত্র গজিয়ে উঠছে অসংখ্য সাহিত্য সংগঠন। তারা এ ওকে ক্রেস্ট দিচ্ছেন। দেদার ওপারের কবিরা আসছেন, এরাও যাচ্ছেন। ধন্য হচ্ছেন। উদ্দেশ্য যদি হতো সংস্কৃতির লেনদেন, অসুবিধা ছিল না মোটেও। কিন্তু নেপথ্যে রয়েছে অন্য এক গন্ধ, বদ গন্ধ। বিদেশের লেখকদের জন্য পুরস্কার রয়েছে। বেশ। ভালো লেখেন পাবেন না কেন। কিন্তু কথা আছে। অনেক রক্ত ঝরিয়ে তো স্বাধীন হয়েছে দেশটা। এ দেশের মাটি কামড়ে পড়ে থেকে, মশা মাছি জানজট সহ্য করে যে লেখকরা লিখে যাচ্ছেন তাদের দাবি বোধহয় একটু বেশি।

শর্ষিনার পীর সাহেব সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার পাননি। আর যে নারী লেখকের একুশে পদক নিয়ে অনেক কথা হয়েছিল আমি নিঃশঙ্ক চিত্তে বলতে পারি, এখন যারা পাচ্ছেন এদের থেকে তিনি অনেক যোগ্য।

পুরস্কার ইতোমধ্যে নোংরা মেখে যথেষ্ট অপরিষ্কার হয়েছে। ফ্রেশ, রিন, সার্পএক্সএল কিছুই আর সহজে এ নোংরা পরিষ্কার করতে পারবে  না। খোল নলচে না বদলালে নোংরা পরতের উপর পরত পড়তেই থাকবে। আর একসময় এটাই সহনীয় হয়ে যাবে। কেউ কিছু বলবে না। যেমন অনেক বিষয়েই এখন আর কেউ কিছু বলে না।
আফরোজা পারভীন, কথাশিল্পী, কলাম লেখক, সম্পাদক।