• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

স্বাগত মাহে সফর: করণীয় ও বর্জনীয়

– নীলফামারি বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১ অক্টোবর ২০১৯  

ইসলামি মাস তথা হিজরি বর্ষের দ্বিতীয় মাসের নাম হচ্ছে সফর। 

এ মাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ের বর্ণনা কোরআন ও হাদিসের আলোকে সংক্ষিপ্তভাবে এখানে তুলে ধরছি। বুঝার সুবিধার্থে আলোচনার ধারাবহিকতা নিম্নরূপ-

সময়ের দীর্ঘ রশিকে বিভিন্ন ভাগ ও অংশে বিভক্তির রহস্য: 
সময় ও কালের দীর্ঘ রশিকে নির্দিষ্ট একেকটি ভাগ ও অংশে নির্ধারণ করা যেমন : সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা. দিন-রাত, মাস-বছর ও যুগ ইত্যাদি। অনুরূপভাবে নির্দিষ্ট নামে নামকরণ, যেমন : সাপ্তাহিক বারের নাম, মাসের নাম, যুগের ভাগ ইত্যাদি, এগুলো সবই মহান রবের পক্ষ থেকে মানব জাতির জন্য এক মহা নিয়ামত বটে। মানুষের যাবতীয় কাজ-কর্ম সুন্দর ও সুশৃংখলভাবে সম্পাদিত হওয়ার মধ্যে রয়েছে তার বড় প্রভাব। যদি এমনটি না হত তাহলে ব্যাপারটি যে কত বড় বিদঘুটে ও উদ্বেগ সৃষ্টির কারণ হয়ে যেত, তা ভাষায় ব্যক্ত করার কোনো অপেক্ষা রাখে না। কালের এই দীর্ঘ রশিকে বিভিন্ন ভাগ, অংশে ও নামে বিভক্তি করণ মানবের মঙ্গলের জন্য। এতে অমঙ্গলের লেশমাত্র নেই। মানুষের সীমিত জ্ঞান দ্বারা যদি নির্দিষ্ট কোনো সময়, দিন-রাত, বার বা মাসকে অমঙ্গল ধরা হয়, তাহলে কিন্তু তা অসীম জ্ঞানের অধিকারী মহান আল্লাহর নিয়ম-নীতি ও নেয়ামের মধ্যেই ত্রুটি বের করার নামান্তর, যা একজন মুমিনের জন্য ধ্বংসাত্বক ভাইর‌্যাস বৈ কিছুই নয়।

কোনো দিন-ক্ষণ ও মাসকে অশুভ মনে করা এবং কালকে গালমন্দ করা যাবে না আমাদেরকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, কোনো স্থান, সময় ও মাসকে অশুভ ও অমঙ্গল মনে করা ইসলামি বিশ্বাসের চরম পরিপন্থি একটি কুসংস্কার। যার সূচনা হয় আরবের জাহিলি সমাজ থেকে। তারা ‘সফর’ মাসকে অশুভ ও বিপদ-আপদের মাস বলে বিশ্বাস করত। এটা ওই সমাজের অগণিত কুসংস্কারের অন্যতম একটি। এমাসে কোনো শুভ কাজ যেমন, বিবাহ-শাদী, নতুন ইমারত নির্মাণ, দূরের কোনো সফর ইত্যাদি বিষয় থেকে বিরত থাকত। রহমতের নবী দিশেহারা মানবের রাহবার সরওয়ারে কায়েনাত হজরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) যার এ ধরাপৃষ্ঠে আগমনের অন্যতম ও প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তাযকিয়া তথা আত্মশুদ্ধি। মহান রবের নির্দেশে তিনি মানবের বিশ্বাস ও চেতনাকে পরিশুদ্ধ-নির্মল করে নবুওয়াতের গুরু দ্বায়িত্ব শত ভাগ পালন করেছেন। শুধু এতটুকুই করে ক্ষান্ত হননি, বরং কিয়ামত পর্যন্ত বিশ্ব মানবতার জন্য এমন দুই পরশপাথর (কোরআন ও সুন্নাহ) রেখে গেছেন, যার স্পর্শে মানবাত্মার সকল মরিচিকা দূর হয়ে সে একজন খাঁটি সোনার মানুষ বনে যেতে পারে। তিনি এই কুসংস্কারের প্রতিবাদে দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করেন : ‘রোগ লেগে যাওয়া, কুলক্ষণ, পেঁচা ও সফর মাসের অশুভত্বের কোনো বাস্তবতা নেই।’ 
(বুখারী শরীফ : হা: ৫৭৫৭, ৫৭৭০, মুসলিম শরীফ : ২২২০)

এমনিভাবে আমাদের সমাজের অনেকে দ্বীণ সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় সময় ও যুগকে গালি দিয়ে বসে। অথচ হাদিসের মধ্যে দ্ব্যার্থহীন কন্ঠে ঘোষণা করা হয়েছে-

عن أبي هريرة عن النبي صلى الله عليه وسلم قال لا تسبوا الدهر فإن الله هو الدهر .
‘হজরত আবুহুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা যমানাকে গালি দিওনা, কারণ আল্লাহ নিজেই হলেন যমানা।’ (মুসলিম শরীফ : হা:  ২২৪৬)

عن ابى هريرة رضي الله عنه قال رسول الله صلى الله عليه وسلم قال الله يسب بنو آدم الدهر وأنا الدهر بيدي الليل والنهار
‘হজরত আবুহুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ বলেন: ‘আদম সন্তান যমানাকে গালি দেয়, অথচ আমিই হলাম যমানা, রাত-দিন আমার হাতে।’ (বুখারী শরীফ : হা:  ৫৮২৭)

عن أبي هريرة عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: " قال الله تعالى: يؤذيني ابن آدم يسب الدهر وأنا الدهر، أقلب الليل والنهار"
‘হজরত আবুহুরায়রা (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেন: ‘আদম সন্তান যমানাকে গালি দিয়ে আমাকে কষ্ট দেয়। অথচ আমি নিজেই যমানা, রাত-দিনকে আমি পরিবর্তন করি।’ (বুখারী শরীফ : ৭৪৯১, সুনানে আবুদাউদ : ৫২৭৪)

সফর মাসকে কেন্দ্র করে উদ্ভট কিছু বিদাত ও ঈমান বিধ্বংসী আকিদা : আরবরে সেই জাহিলিয়াত সমাজের মত আজো মুসলিম সমাজে অনেকের মধ্যে কুসংস্কার পরিলক্ষিত হয়। সফর মাসকে কেন্দ্র করে ফজিলতের নামে কুসংস্কারের প্রচার করা হয়। শুধু তাই নয়, এ সকল কুসংস্কারকে উস্কে দেয়ার জন্য অনেক বানোয়াট কথা হাদিসের নামে বানিয়ে সমাজে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। যেমন তারা বলে, এ মাস বালা-মুসিবতের মাস। এ মাসে এত লক্ষ এত হাজার বালা-মুসিবাত নাজিল হয়। এ মাসে আদম (আ.) ফল খেয়েছিলেন। এ মাসেই হাবীল নিহত হন। এ মাসেই হজরত নূহ (আ.) এর কওম ধ্বংস হয়। এ মাসে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে আগুনে ফেলা হয়। এ মাসের আগমনে রাসূল (সা.) ব্যথিত হতেন। এ মাস চলে গেলে খুশি হতেন। তিনি বলতেন, ‘যে ব্যক্তি আমাকে সফর মাস অতিক্রান্ত হওয়ার সুসংবাদ প্রদান করবে, আমি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করার সুসংবাদ প্রদান করবো।’ ইত্যাদি ইত্যাদি কথা তারা বানিয়েছে।

মুহাদ্দিসগণ একমত যে, সফর মাসের অশুভত্ব ও বালা-মসিবত বিষয়ক সকল কথাই ভিত্তিহীন ও মিথ্যা এবং এ মাসে বিশেষ কোনো ইবাদতের কথাও কিন্তু মুহাদ্দিসিনে কেরাম ও ফুকাহাদের থেকে বর্ণিত নেই। অথচ তারা বানিয়েছে যে, কেউ যদি সফর মাসের ১ম রাত্রিতে মাগরিবের পরে বা এশার পরে চার রাকাত নামাজ আদায় করে, অমুক অমুক সূরা বা আয়াত এতবার পাঠ করে, তবে সে বিপদ থেকে রক্ষা পাবে, এত এত পুরস্কার পাবে। এ সবই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা বৈ কিছুই নয়।

তবে একথা ঠিক যে, কোনো কোনো মাস ও দিন অপেক্ষাকৃত অন্যান্য মাস ও দিন থেকে অধিকতর বরকতপূর্ণ, যা শরিয়তের গ্রহণযোগ্য দলীলের ভিত্তিতে সাব্যস্ত হয়েছে। কিন্তু সেখানে শুভ ও অশুভ বিষয়ে কোনো কথা বলা হয়নি। কেবল ফজিলতময় দিন ও মাস নির্ণয় করা হয়েছে। বাজারে ‘বার চাঁদের ফজিলত’সহ কিছু বই-পুস্তক পাওয়া যায়, তাতে সফর মাসের বিভিন্ন ধরণের আমলের কথা বলা আছে। যার কোনো প্রমাণ ইসলামি শরিয়তে খুঁজে পাওয়া যায় না।

আখেরি চাহার শোম্বা : এমন একটি কথা বিভিন্ন বাজারি বই-পুস্তক ও মানুষের মুখে শোনা যায়। আর একথাটি ফার্সী ভাষায়- যার অর্থ ‘সফর মাসের শেষ বুধবার।’ যেহেতু সফর মাস পুরাটাই অশুভ তাই সফর মাসের শেষ বুধবার সবচেয়ে অশুভ দিন এবং এ দিনে সবচেয়ে বেশি বালা-মুসিবত নাজিল হয়। জনৈক জালিয়াতী লিখেছে, ‘সফর মাসে এক লাখ বিশ হাজার বালা-মুসিবত নাজিল হয় এবং সব দিনের চেয়ে বেশি আখেরি চাহার শোম্বাতে নাজিল হয়। সুতরাং ওই দিনে যে ব্যক্তি এই..এই.. নিয়মে চার রাকাত নামাজ আদায় করবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে ওই বালা থেকে রক্ষা করবেন এবং পরবর্তী বছর পর্যন্ত তাকে হেফাজত রাখবেন।

তবে আমাদের দেশে বর্তমান ‘আখেরি চাহার শোম্বা’র প্রসিদ্ধি অন্য কারণে। আর তা হলো, রাসূলুল্লাহ (সা.) সফর মাসের শেষ দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি সফর মাসের শেষ বুধবারে কিছুটা সুস্থ হন এবং গোসল করেন। এরপর তিনি পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এই অসুস্থতাতেই তিনি পরের মাসে ইন্তেকাল করেন। এজন্য মুসলমানরা এই দিনে তাঁর (সা.) সর্বশেষ সুস্থতা ও গোসলের স্মৃতি উদযাপন করেন।

যা-ই হোক, উপরের আলোচনা দ্বারা আমরা স্পষ্টভাবে জানতে পারলাম যে, সফর মাসের শেষ বুধবারে বিশেষ কোনো আমলের কথ ইসলামে নেই।

রাসূলুল্লাহ (সা.) এর হায়াতে ঘটে যাওয়া এ মাসের ঐতিহাসিক কিছু ঘটনা:

(ক) আল্লামা ইবনু কাইয়ুম (রহ.) বলেন, ইসলামের সর্ব প্রথম গাযওয়া (যে যূদ্ধে রাসূল (সা.) নিজে অংশগ্রহণ করেছেন) ‘আব্ওয়া’ বা ‘ওয়াদ্দান’ দ্বিতীয় হিজরতে সফর মাসের ২য় তারিখে সংগঠিত হয়। এ যুদ্ধের পতাকা ও ঝাণ্ডা ছিল সাদা রঙ বিশিষ্ট এবং তার বাহক ছিলেন হজরত হামযা বিন আব্দিল মুত্তালিব (রা.)।

(খ) হিজরতের তৃতীয় বছর সফর মাসে ‘আদাল ও আল্ক্বারাহ’ গোত্রের বিশ্বাস ঘাতকতায় ইবনু ইসহাকের বর্ণনা মতে ছয় জন এবং ইমাম বুখারী (রহ.) মতানুসারে দশ জন ক্বারী শাহাদতবরণ করেন।

(গ) চতুর্থ হিজরীর সফর মাসে বিরে মা‘ঊনার ঘটনা সংগঠিত হয়। 

(ঘ) আল্লামা ইবনুল কাইয়্যুমের বর্ণনা মতে খাইবার যুদ্ধে রওনার সময় ছিল মহররমের শেষ দিকে কিন্তু বিজয় অর্জন হয় সফর মাসে। (যাদুল মা‘আদ : ৩/১৬৪, ২৪৪, ৩৩৯,৩৪০)

শেষ কথা:
মানবজাতিকে সর্বপ্রকার অন্ধকার থেকে মুক্ত করার জন্যই পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন,

كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ
‘এটি সেই কিতাব যা আমি তোমার প্রতি নাজিল করেছি যেন তুমি মানুষকে বের করে আন অনেক অন্ধকার থেকে এক আলোর দিকে।’ (সূরা ইব্রাহিম : আয়াত-১)

সুতরাং মহান আল্লাহর দরবারে বিশেষ আকুতি, তিনি যেন আমাদেরকে সব ধরনের কুসংস্কার ও অন্ধকার থেকে চিরমুক্তি দান করেন। আমিন।