• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

সর্বশেষ:
যুদ্ধের অর্থ জলবায়ু পরিবর্তনে ব্যয় হলে বিশ্ব রক্ষা পেত- প্রধানমন্ত্রী দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড মেডিকেল কলেজের ক্লাস অনলাইনে নেয়ার নির্দেশ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ‘গণতান্ত্রিক রীতিনীতি না মানলে জনগণই বিএনপিকে প্রতিহত করবে’ লালমনিরহাটে হত্যা মামলায় বিএনপির দুই নেতা কারাগারে

দিনাজপুরের ‘প্রথম’ মসজিদ চেহেলগাজী

– নীলফামারি বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৮ মার্চ ২০২৩  

 
দিনাজপুরের ৫৬৩ বছরের একটি প্রাচীন নিদর্শন চেহেলগাজী মসজিদ। ধারণা করা হয়, সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহর রাজত্বকালে (১৪৬০-১৪৭৪ সাল) বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার নির্মিত এটিই প্রথম মসজিদ। এটির পূর্বপাশে রয়েছে চেহেলগাজী মাজার। তবে প্রাচীন এই মসজিদটির নাম পুরাকীর্তি হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাতে নেই। স্থানীয় সচেতন মহল এটিকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকায় স্থান দেওয়ার দাবি জানিয়েছে।

দিনাজপুর সদর উপজেলার চেহেলগাজী গ্রামে মসজিদটি অবস্থিত। জেলা সদর থেকে এর দূরত্ব প্রায় সাত কিলোমিটার উত্তরে। মসজিদের কালনির্দেশক তিনটি শিলালিপি ছিল। এর একটি দিনাজপুর জাদুঘরে ও দুটি জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

এ শিলালিপি থেকে জানা যায়, ৮৬৫ হিজরির ১৬ সফর (১৪৬০ সালের ১ ডিসেম্বর) মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহর রাজত্বকালে তার উজির ইকরার খানের নির্দেশে তৎকালীন পূর্ণিয়া জেলার অন্তর্গত জোর ও বারুর পরগনার শাসনকর্তা উলুঘ নুসরত খান বৃহত্তর দিনাজপুরে এই মসজিদটি নির্মাণ করেন।

বর্তমানে মসজিদটির দেওয়াল ছাড়া আর কোনো অংশ অবশিষ্ট নেই। দেওয়ালগুলোও ভগ্নপ্রায়। দেওয়ালে কোনো অলঙ্করণ দেখা যায় না। তবে মেহরাবের কাছে কিছু পোড়ামাটির ফলক এখনো বর্তমান। এগুলোর বেশিরভাগই খুলে পড়ছে।

বর্গাকার মসজিদটির মূল কক্ষের ওপর একটি এবং পূর্বদিকের বারান্দার ওপর সম্ভবত তিনটি গম্বুজ ছিল। মসজিদের স্থাপত্য পরিকল্পনার এ রীতি মোগল যুগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

বাইরের দিকে মসজিদের মূলকক্ষের আয়তন ৪ দশমিক ৯০ মিটার। মূলকক্ষের পূর্বদিকে তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণে একটি করে দুটি খিলানযুক্ত প্রবেশপথ আছে। পূর্বদিকের তিনটি প্রবেশপথের মধ্যে মাঝের খিলানের উচ্চতা ২ দশমিক ৬০ মিটার এবং প্রস্থ শূন্য দশমিক ৭৭ মিটার।

পূর্বদিকের বারান্দার দৈর্ঘ্য ৪ দশমিক ৯০ মিটার এবং প্রস্থ ১ দশমিক ৮৩ মিটার। বারান্দায় প্রবেশের জন্য মূলকক্ষের পূর্বদিকের অনুরূপ আয়তনবিশিষ্ট তিনটি খিলানযুক্ত প্রবেশপথ রয়েছে। মসজিদের ভেতরে পশ্চিমদিকে রয়েছে তিনটি মেহরাব। মাঝের মেহরাবটি পাশের দুটির তুলনায় একটু বড়। মেহরাবগুলো বহুপত্র খিলানবিশিষ্ট। মেহরাবের অলঙ্করণে পাথর দেখা যায়। পাথর ও পোড়ামাটির ফলক দিয়ে এ মেহরাবগুলো সুন্দরভাবে অলঙ্কৃত। পোড়ামাটির ফলকগুলোর মধ্যে ফুল, লতাপাতা ও ঝুলন্ত মোটিফ লক্ষণীয়।

এদিকে, মাজারটিতে সময় নির্দেশক কোনো শিলালিপি পাওয়া যায়নি। দিনাজপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক ওয়েস্টমেকট ১৮৭৪ সালে চেহেলগাজী মসজিদ থেকে তিনটি শিলালিপি উদ্ধার করেন। এ শিলালিপি থেকে জানা যায়, ১৪৬০ সালে চেহেলগাজী মসজিদটি নির্মাণ করার সময় মাজারটি সংস্কার করা হয়। অর্থাৎ মসজিদের আগেই মাজারটির অস্তিত্ব ছিল। শিলালিপিতে চেহেলগাজী বা অন্য কোনো নামের উল্লেখ নেই। বুকানন হ্যামিল্টনের প্রতিবেদন থেকে প্রথম চেহেলগাজী মাজার সম্পর্কে জানা যায়।

স্থানীয় জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, ৪০ জন গাজীকে একত্রে এখানে সমাহিত করা হয়। এজন্য এ স্থানের নাম হয় চেহেল (চেহেল ফার্সি শব্দ, বাংলায় এ শব্দের অর্থ চল্লিশ), গাজী (ধর্মযোদ্ধা)। গোপাল নামে এক স্থানীয় হিন্দু রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ওই গাজীদের ৩৭ জন শহীদ হয়েছিলেন। পরে বাকি তিনজনে যুদ্ধ করে জয় লাভ করেন। পরবর্তীকালে তারা মৃত্যুবরণ করলে তাদেরও এখানে সমাহিত করা হয়।

সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের কামরূপ অধিকারের সময় (১৩৫৮ সাল) সম্ভবত এ যুদ্ধটি হয়েছিল। এরকম কান্তনগরে (গড় মল্লিকপুর) এবং খানসামায় আরও দুটি যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং নিহত সৈনিকদের যৌথভাবে সমাহিত করা হয়। প্রায় ১০০ বছর পরে ১৪৬০ সালে মাজারটি মেরামত করা হয়।

আগে মাজারের ওপরে কোনো আচ্ছাদন বা ছাদ ছিল না। ১৯৬৮ সালে এ মাজারের ওপরে ছাদ নির্মাণ করা হয়। চারপাশে দেওয়াল তৈরি করে মাজারটিকে আবৃত করা হয় মূল্যবান রেশমি কাপড়ে এবং নির্মিত হয় তোরণ। নবনির্মিত ঘরটির আয়তন ২৫ দশমিক ১৫ মিটার। মাজার সংলগ্ন পূর্বদিকে একটি, দক্ষিণ দিকে তিনটি বাঁধানো প্রাচীন কবর রয়েছে, দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে চেহেলগাজী মসজিদ, মসজিদের দক্ষিণে আরও একটি নতুন মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। উত্তর-পশ্চিম কোণে ১৭০ মিটার আয়তনবিশিষ্ট উত্তর-দক্ষিণে লম্বা একটি প্রাচীন পুকুর রয়েছে। পূর্বদিকে এর চেয়ে ছোট আরেকটি প্রাচীন পুকুর অবস্থিত। মাজারের পশ্চিম দিকে শালবন।

এখনো ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা পুরোনো এই মসজিদে নামাজ আদায় করেন। বর্তমানে ৩০ থেকে ৪০ জনের নামাজ পড়ার মতো জায়গা আছে। সরকারিভাবে পুরো মসজিদের ওপরিভাগে টিনের চালা তৈরি করা হয়েছে। তাতে বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেলেও সংস্কার বা সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় মসজিদটি হারিয়ে যেতে বসেছে।

এত বছরের পুরোনো একটি নিদর্শন পুরাকীর্তির তালিকায় না থাকায় হতাশ জেলার সুধীসমাজ। বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনো গবেষণাকাজও হয়নি এতকাল। প্রত্নতত্ত্ব আইন-২০১৫-তে বলা হয়েছে, ঐতিহাসিক, জাতিতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক, সামরিক অথবা বৈজ্ঞানিক মূল্যসমৃদ্ধ যে কোনো প্রাচীন নিদর্শন বা স্থান ১০০ বছরের পুরোনো হলেই তা প্রত্নসম্পদের আওতাভুক্ত হবে। কিন্তু দিনাজপুরের চেহেলগাজী মাজার ও মসজিদ সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কাছে।

মসজিদ ও মাজারের খাদেম মো. মোমিনুল ইসলাম জানান, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের একদল গবেষক নকশা দেখে মসজিদটি সুলতানি আমলের নিদর্শন বলে জানিয়েছেন। এছাড়া মসজিদে নির্মাণকাল নির্দেশক তিনটি শিলালিপি ছিল। এর একটি দিনাজপুর জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। এই শিলালিপি থেকে জানা যায়, ১৪৬০ সালে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। সে হিসাবে এ স্থাপনার বয়স ৫৬৩ বছর।

চেহেলগাজী মসজিদের পেশ ইমাম হাফেজ মো. আফজালুল হক বলেন, ইরাকের বাগদাদ থেকে ইসলাম ধর্ম প্রচারে আসা ৪০ জন গাজীর সঙ্গে গোপাল রাজার যুদ্ধ চলাকালে ৩৭ জন শহীদ হন। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করেন তিনজন এবং জয়লাভ করেন। পরবর্তীকালে তারা মৃত্যুবরণ করলে তাদেরও এখানে সমাহিত করা হয়। তাদের কবর ঘিরেই এই মাজার। ওই তিন গাজী মধ্যে একজনের নাম জানা গেছে । তিনি জয়নুদ্দিন বাগদাদি।

তিনি আরও বলেন, মসজিদ ও মাজার চত্বরে পুরোনো তিনটি কবর আছে। এরমধ্যে একজনের নাম-পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি গোপাল রাজার সেনাপতি বলরাম সেন। তিনি পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তার নাম রাখা হয় আল-আমিন। বাকি দুটি কবর কার তা সঠিক জানা যায়নি।

হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবু তোয়াব মো. শাহরিয়ার বলেন, নির্মাণ সাল জানা গেলেও মসজিদটির বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি। এটি সংস্কারে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে দায়িত্ব দেওয়া দরকার বলে মত দেন তিনি।

সরেজমিনে দেখা যায়, মসজিদের অলঙ্কৃত মেহরাব অরক্ষিত, অনেকাংশ ভেঙে গেছে। এর দুইপাশে দুটি ছোট মেহরাবের অবস্থাও একই। মসজিদটি তিন গম্বুজবিশিষ্ট এবং সামনে একটি সুসজ্জিত দরজা ভেদ করে বারান্দা। সামনে তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একটি করে দরজা রয়েছে।

রংপুর থেকে আসা সাজ্জাদ হোসেন বলেন, আমি মাজার জিয়ারত করতে এসেছিলাম। আমি জানতাম না এখানে ৫৬৩ বছরে পুরোনো একটি মসজিদ আছে। এটা আমাদের কাছে একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। আগামী প্রজন্মের কাছে কালের সাক্ষী হিসেবে মসজিদটি রক্ষা করা দরকার।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের রংপুর-রাজশাহী বিভাগের আঞ্চলিক অফিসের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, পুরাকীর্তির অংশ হওয়া একটি চলমান প্রক্রিয়া। দিনাজপুরে এখনো জরিপ শেষ হয়নি। শিগগির স্থাপনাটি পরিদর্শন করা হবে।