• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

পদ্মাসেতু নির্মাণে সেনাবাহিনী

– নীলফামারি বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৫ জুন ২০২২  

দেখেছে কিভাবে একটি একটি করে পিলার ও স্প্যান উম্মত্ত পদ্মার বুক চিড়ে তৈরি হয়েছে। আজ পদ্মাসেতু ও সেতু-সংলগ্ন অন্যান্য অবকাঠামো গর্বের সঙ্গে মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে আছে। আর এ সেতুর নিরাপত্তা, নির্মাণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে সম্পৃক্ত ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

এক নজরে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী-
 
* ১০.৫ কিমি দীর্ঘ জাজিরা অ্যাপ্রোচ রোড এবং ব্রিজ অ্যান্ড ফ্যাসিলিটিজ।
* ১.৬৭ কিমি দীর্ঘ মাওয়া অ্যাপ্রোচ রোড এবং ব্রিজ অ্যান্ড ফ্যাসিলিটিজ।
* মুল সেতু ও নদী শাসনে নিয়োজিত সহস্রাধিক প্রকৌশলী, দেশি-বিদেশী পরামর্শক এবং সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন ব্যবস্থা।
*একটি পূর্ণাঙ্গ ব্রিগেড (৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেড) কর্তৃক সেতুর সামগ্রিক নিরাপত্তা।
* নদী ভাঙন রোধকল্পে নদীর তীরবর্তী মাওয়া-কান্দিপাড়া-যশোলদিয়া এলাকায়। ১ হাজার ৩০০ মিটার আপৎকালীন জরী নদীশাসন।
* কাঁঠালবাড়ী ফেরিঘাট সংযোগ সড়ক (৬ কিমি) প্রশস্তকরণ। শিমুলিয়া ফেরিঘাট এলাকার ৩ কিমি রাস্তা।
* পদ্মাসেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিমি। দীর্ঘ অত্যাধুনিক রেললাইন।
* ঢাকা থেকে মাওয়া এবং জাজিরা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত সর্বমোট ৫৫ কিমি দীর্ঘ দেশের সর্বপ্রথম অ্যাক্সেস কন্ট্রোলড এক্সপ্রেসওয়ে (এন-৮)।
* পদ্মা বহুমুখী সেতু ও পদ্মাসেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন এলাকায় ভূমি উন্নয়ন, স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণ ও সংস্কার।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য প্রমত্ত পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত সুপ্রশস্ত পদ্মা সেতু আজ এক বাস্তবতা। ১৯৯৮-৯৯ সালে পদ্মা নদীতে সেতু নির্মাণের প্রাক-সমীক্ষা সম্পন্ন করা হয়েছিল বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে সেতুর প্রাথমিক নকশা সম্পন্ন হওয়ার পর দেশবাসীর স্বপ্ন যখন কুঁড়ি হয়ে কেবল মেলতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই দেখা দেয় অর্থায়নের অনিশ্চয়তা। দেশের এ সংকটময় মুহূর্তে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণের এক যুগান্তকারী ও বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। শুরু হয়ে যায় পদ্মাসেতু নির্মাণের বিশাল প্রকল্পমালা, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সেতু বিভাগের সার্বিক তত্ত্বাবধানে শুরু হয় পদ্মাসেতু নির্মাণ ও আনুষঙ্গিক কার্যাবলী।

মূল কাজ শুরুর ঠিক আগে পদ্মাসেতুর অ্যালাইনমেন্ট বরাবর নদীর ব্যাপক ভাঙন মোকাবিলায় সেতু বিভাগের অনুরোধে এগিয়ে আসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। পদ্মা নদীর পাড় বরাবর মাওয়া-কান্দিপাড়া-যশোলদিয়া এলাকায় ১.৩ কিলোমিটার নদী শাসন সম্পন্ন করে পদ্মাসেতুর মূল এলাইনমেন্টকে বড় ধরনের ঝুঁকি থেকে মুক্ত করা হয়। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাত ধরে ২০১৩ সালের ৮ অক্টোবর জাজিরা অ্যাপ্রোচ রোড শুরু করার মাধ্যমে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয়।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ‘জনগণের সেনাবাহিনী’ দেশ ও জনগণের জন্য যেকোনো চ্যালেঞ্জিং কাজে সর্বদাই এগিয়ে এসেছে। পদ্মাসেতু নির্মাণেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ২০১৩ সালের ২৫ জানুয়ারি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের বার্ষিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত খ্যাতিমান প্রকৌশলী ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনার সময় পদ্মাসেতু নির্মাণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে মত প্রকাশ করেন।

ইতোপূর্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকৌশলীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে অসংখ্য রাস্তা, কক্সবাজারে মেরিন ড্রাইভ, মিরপুর-এয়ারপোর্ট রোড ফ্লাইওভার, জাতীয় মহাসড়ক, হাতিরঝিল প্রজেক্টসহ অনেক প্রকল্প সূচারুরূপে সম্পাদন করায় পদ্মাসেতু নির্মাণে সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা অত্যন্ত যৌক্তিক। ফলত এই সেতু তৈরির প্রথম থেকেই সেতু সংশ্লিষ্ট সকল স্থাপনার নিরাপত্তা এবং গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শক হিসেবে সেতু বিভাগ কর্তৃক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করা হয়।

পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের কাজ মোট ৫টি প্যাকেজের আওতায় পরিকল্পিত করা হয়। সেগুলো হলো- মূল সেতু, নদীশাসন, দক্ষিণ প্রান্তে ১০.৫৭ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ রোড, উত্তর প্রান্তে ১.৬৭ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ রোড এবং প্রকল্পে নিয়োজিত পরামর্শক ও প্রকৌশলীগণের বাসস্থান (সার্ভিস এরিয়া-২)।

তিনটি প্যাকেজের (জাজিরা ও মাওয়া অ্যাপ্রোচ রোড এবং সার্ভিসের এরিয়া-২) জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আব্দুল মোনেম লিমিটেড-হাইওয়ে কনস্ট্রাকশন ম্যানেজমেন্ট এবং পরামর্শক হিসেবে কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালট্যান্ট এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে নিযুক্ত করা হয়।

পরবর্তী সময়ে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মূল সেতু ও নদীশাসনের কাজের জন্য যথাক্রমে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড ও সিনোহাইড্রো কর্পোরেশন লিমিটেডকে নিয়োগ করা হয়। এভাবে সরকার বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহদাকার মেগা প্রকল্পে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত করে।

এর পাশাপাশি স্ট্র্যাটেজিক এই সেতুর সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেড নামে একটি নতুন ব্রিগেড গঠন করে, যার কার্যক্রম ২০১৪ সালের ১২ মার্চ থেকে শুরু হয়।

পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক সম্পাদিত কাজগুলো হল-

জাজিরা অ্যাপ্রোচ রোড-

এই অ্যাপ্রোচ রোডে রয়েছে ৪ লেন বিশিষ্ট ১০.৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ মূল সড়ক, ২ লেন বিশিষ্ট ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ সার্ভিস সড়ক, ৫টি সেতু, ৮টি আন্ডারপাস, ২০টি কালভার্ট, ১টি সার্ভিস এরিয়া, টোলপ্লাজা, থানা এবং ফায়ার স্টেশন বিল্ডিং। বর্ণিত কাজ ২০১৩ সালে শুরু হয়ে শেষ হয়েছে ২০১৭ সালে।

মাওয়া অ্যাপ্রোচ রোড-

এই অ্যাপ্রোচ রোডে রয়েছে ৪ লেনবিশিষ্ট ১.৬৭ কিলোমিটার দীর্ঘ মূল সড়ক, ২ লেন বিশিষ্ট ১.৮৯ কিলোমিটার সার্ভিস সড়ক, একটি কালভার্ট, সার্ভিস এরিয়া, টোলপ্লাজা, থানা এবং ফায়ার স্টেশন বিল্ডিং।

সার্ভিস এরিয়া-২

এই এরিয়ার মধ্যে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত ৩০টি কটেজ, রিসিপশন বিল্ডিং, সুপারভিশন অফিস, সুইমিং পুল, টেনিস কমপ্লেক্স ও মোটেল মেস তৈরি করা হয়েছে। ২০১৪ সালে শুরু হয়ে ২০১৬ সালে এই প্যাকেজের কাজ শেষ হয়েছে।

জাতীয় মহাসড়ক এন-৮

দেশের সর্বপ্রথম অ্যাক্সেস কন্ট্রোলড এক্সপ্রেসওয়ে এন-৮ পদ্মাসেতুকে উত্তরে ঢাকা এবং দক্ষিণে ফরিদপুরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি এন-৮ মহাসড়কটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এই মহাসড়কটির কাজ ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট উদ্বোধন করেন এবং ২০২০ সালের ১২ মার্চ এর কাজ সমাপ্ত হয়।

মহাসড়কটি ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ, যার আওতায় রয়েছে ৫টি ফ্লাইওভার, ২টি ইন্টারচেঞ্জ, ৪টি ওভারপাস, ২৯টি সেতু, ৫৪টি কালভার্ট এবং ১৯টি আন্ডারপাস। পদ্মাসেতু উদ্বোধনের পর এন-৮ সড়ক ব্যবহার করে অতি স্বল্প সময়ে মানুষ ও মালামাল দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলা থেকে রাজধানী ঢাকায় পৌঁছাতে পারবে, যা ঐ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে করবে ত্বরান্বিত।

পদ্মাসেতু রেল সংযোগ প্রকল্প-

সাশ্রয়ী মূল্যে বিপুল পরিমাণ যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের সুবিধার্থে পদ্মাসেতুর মূল নকশায় নিচের স্তরে ব্রডগেজ রেললাইনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পদ্মাসেতু রেল সংযোগ প্রকল্প নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ সরকারের একটি সময়োপযোগী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালট্যান্টের তত্ত্বাবধানে ও বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের মাধ্যমে এই প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। প্রকল্পটি আর্থিক বিবেচনায় (৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা) বাংলাদেশ সরকারের সর্ববৃহৎ প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম। ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী প্রকল্পটি উদ্বোধন করেন।

এই রেল প্রকল্পটির দৈর্ঘ্য ১৭২ কিলোমিটার এবং এর আওতাধীন রয়েছে ২৩.২৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ভায়াডাক্ট বা উড়াল রেল সেতু, ৫৯টি বড় দৈর্ঘ্যের সেতু, ১৪২টি কালভার্ট, ১৩৫টি আন্ডারপাস ও ২০টি স্টেশন। এ পর্যন্ত প্রকল্পের শতকরা ৬০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

পদ্মাসেতু এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদির নিরাপত্তা-

দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, জিডিপির প্রবৃদ্ধি, জনসাধারণের জীবনযাপনের মানোন্নয়নের পাশাপাশি কৌশলগত কারণে স্ট্র্যাটেজিক এই সেতুর গুরুত্ব অপরিসীম। এর নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেডকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যাদের বলা হয় ‘প্রটেক্টর অব পদ্মা ব্রিজ’। এই ব্রিগেডটি ২০১৩ সাল থেকেই সেতু, সংশ্লিষ্ট জনবল, নানাবিধ স্থাপনা ও সেতুর নিচে বিস্তীর্ণ নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আসছে।