• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

নীলফামারীর এখন বাসিরন স্বাবলম্বী      

– নীলফামারি বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১০ মার্চ ২০২২  

পরিবারের চাপে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় পাশের বাড়ির এক ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই শিশু থেকে হয়ে ওঠেন বাড়ির বড় বউ। যখন বই নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা তখন তাকে সংসারের কাজ করতে হতো। বিয়ের পর থেকে চলতো স্বামীর নির্যাতন।

একসময় গর্ভে সন্তান আসে। কিন্তু সন্তান নষ্ট করতে চাইতেন স্বামী। এজন্য জন্য চলতো নির্যাতনও। তাই সন্তানকে বাঁচাতে স্বামীর বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে আসেন বাবার বাড়ি। নিজের সন্তান ও পরিবারের হাল ধরতে সিদ্ধান্ত নিলেন ঘুরে দাঁড়ানোর। সেই চিন্তায় নেন সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ। এখন অ্যনের জামা-কাপড়ে সেলাইয়ের পাশাপাশি নিজেই দেন প্রশিক্ষণ। বলছিলাম ২৮ বছর বয়সী বাসিরন আক্তারের কথা। তিনি নীলফামারীর ডোমার উপজেলার পশ্চিম বোড়াগাড়ী সবুজ পাড়া গ্রামে প্রতিবন্ধী বাসেত আলীর মেয়ে। জীবন সংগ্রামে তিনি আজ স্বাবলম্বী। তার আয়ে সন্তানের পড়াশোনার খরচের পাশাপাশি চলছে বাবা-মায়ের সংসারও।

বাসিরন আক্তার বলেন, বিয়ের পর থেকে স্বামীর সঙ্গে আমার বনিবনা হতো না। প্রায় প্রতিদিনই সে আমাকে মারধর করতো। সংসারের খরচের কথা বললেই সে আমার গায়ে হাত তুলতো। গরীব বাবার সন্তান হওয়ায় আমি মুখ বুঝে সব সহ্য করতে থাকি। নির্যাতনের কারণে আমার গর্ভে আসা প্রথম সন্তান নষ্ট হয়ে যায়। সে সময় মহিলাবিষয়ক কার্যালয়ে অভিযোগ দিলে তারা স্বামীর সঙ্গে আমার মীমাংসা করিয়ে দেন। এর কিছুদিন পর আমার গর্ভে আবারও সন্তান আসে। সেই সন্তানটিও নষ্ট করার জন্য স্বামী আমাকে প্রচণ্ড মারধর করতো। এক সময় আমি সন্তানকে বাঁচাতে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে বাবার বাড়ি চলে আসি।

তিনি আরও বলেন, বাবা প্রতিবন্ধী হওয়ায় মা নছফান বেগম মানুষের বাসায় কাজ করে আমাদের সংসার চালাতেন। এমনিতেই দরিদ্রতা আমাদের নিত্যসঙ্গী, এর সঙ্গে গর্ভে বাচ্চা নিয়ে বাড়িতে আসায় মায়ের ওপর চাপ আরও বেড়ে যায়। দুই ভাইও সে সময় ছোট তাই মাকে একাই সংসার চালাতো হতো। এক সময় আমার একটি ছেলে সন্তান হয় তার নাম রাখি বাদশা। সন্তান হওয়ার দুই বছর পর আমি যুব উন্নয়নে সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ নেই। এরপর ঋণ নিয়ে সেলাইয়ের কাজ শুরু করি। ধীরে ধীরে কিছু টাকা আয় করতে থাকি। সে টাকা মায়ের হাতে তুলে দেই। এভাবেই সংসার চলতো। নির্যাতনের বিভীষিকা ভুলে সামনে এগিয়ে চলা বাসিরন ২০১৯ সালে উপজেলা জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে জয়িতা পুরস্কার অর্জন করেন। উপজেলা পরিষদের আল আমিন টেইলার্সের দোকানে সেলাইয়ের কাজ করে মাসে খরচ বাদ দিয়ে প্রায় ৭ হাজার টাকার মতো আয় করে থাকেন।

বাসিরন বলেন, এক সময় আমার ছেলে বড় হয়। আমার আয়ও বাড়তে থাকে। আমি যেহেতু পড়াশোনা করতে পারি নাই সেই কষ্ট থেকে ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করে দেই। সে এখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। আমিও নিজে কাজ করার পাশাপাশি অনেক মেয়েদের সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ দেই। যাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি তারাও আজ কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। এক সময়রে দরিদ্রতাকে পেছনে ফেলে আজ আমি স্বাবলম্বী হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি। বিষয়টি কত যে আনন্দের তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।

আশপাশের লোকজনের সমালোচনার বিষয়ে তিনি বলেন, যখন আমি দোকানে সেলাইয়ের কাজ শুরু করি অনেকেই খারাপ মন্তব্য করতো। রাতে দোকান বন্ধ করে বাড়ি যাওয়ার পথে অনেকেই কটু কথা বলতো। এক সময় যারা আমার কাজের সমালোচনা করতো এখন তারাই তাদের সন্তানদের আমার কাছে নিয়ে এসে সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তাই মানুষের কথায় দমে গেলে চলবে না। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হলে কাজ শিখতে হবে। আর কাজ শিখার জন্য শিক্ষার দরকারও আছে।

আল আমিন টেইলার্সের মালিক সামিনা বেগম বলেন, বাসিরন অনেক ভালো কাজ করে থাকে। সে আমার দোকানে সেলাই শিখতে আসা নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। সে এখন কাজে শিখতে আসা নারীদের বুঝায় নিজের পায়ে না দাঁড়ানো পর্যন্ত কেউ যেন বিয়ে না করে। আর সবাইকে শিক্ষিত হতে হবে লেখাপড়া করে।

ডোমার উপজেলা সহকারী উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা এসএম হাবীব মর্তুজা বলেন, বাসিরন এখান থেকে সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ শিকার পর ঋণ নিয়ে সেলাই মেশিন কিনে। আজ সে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। তাকে দেখে এখন অনেক নারী এখানে কাজ শিখতে আসে।
কে/