• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

জলঢাকায় দেড়শ বছরের ঐতিহ্য ‘হাতির কড়াই’

– নীলফামারি বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৯ মে ২০২২  

হাতি নেই কিন্তু ঐতিহ্য পড়ে আছে। প্রায় দেড়শ বছর আগে হাতিকে পানির খাওয়ানোর বিশাল আকৃতির একটি কড়াই। চার হাতল যুক্ত কড়াইটি চারটি খুঁটিতে আটকিয়ে উচু করে রাখা হয়েছে একটি টায়ারের উপর ভর করে। চুরি না হওয়ার জন্য বাড়ির আঙ্গিনায় শিকলে বেঁধে রাখা হয়েছে ছোট একটি আম গাছে।

কড়াইয়ের মালিক মরহুম ভূল্ল্যা মামুদ সরকার তহসিলদারের বংশধররা দাবি করেছেন, কড়াইটি পূর্বপুরুষদের দেড়শ বছরের ঐতিহ্য। দুটি হাতিকে পানি খাওয়ানোর জন্য ভারতের শিলিগুড়ি থেকে আনা হয়েছিলো ট্রেন ও গরুর গাড়ি যোগে। পুরানো ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবে সম্প্রতি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে স্বীকৃতিও মিলেছে কড়াইটির। দেড়শ বছরের স্মৃতিমাখা লোহার কড়াইটি সংরক্ষণের জন্যও জাদুঘরে নিতে চেয়েছিলেন প্রসাশন। এতে আপত্তি তুলেছেন কড়াইটির দাবিদাররা। পূর্বপুরুষদের পুরানো স্মৃতি নিজেদের কাছে রেখে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করতে চান তারা। স্মৃতি বিজরিত কড়াইটির থাকার কারণে এলাকার নামের পরিচিতি পায় ‘হাতির কড়াই’ নামে। এজন্য স্থানীয়রাও হাতছাড়া করতে চান না কড়াইটি। কড়াইটি রক্ষার দাবিতে মানববন্ধনও করেছেন এলাকাবাসী। ঐতিহ্য বহনের এ কড়াইটির সন্ধান মিলেছে নীলফামারীর জলঢাকায় উপজেলার ধর্মপাল ইউনিয়নে। পূর্বপুরুষদের এই কড়াইটি রয়েছে তহসিলদার পাড়ার (হাতির কড়াই পাড়া) বাসিন্দা হাজী এমদাদুল হকের বাড়িতে। ঐতিহ্যের নিদর্শন হওয়ায় দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসছেন দর্শনার্থীরা।

লোহার এই কড়াইটি ২০ফিট বৃত্তের ও ৭ফিট ব্যাস রয়েছে। উচ্চতাও প্রায় ৭ফিট। এটির ওজন ২৮মণ ১কেজি আধা পোয়া ছিলো। তবে লোহার ক্ষয়ের কারণে এখন কিছুটা ওজন কমে গেছে।

জনশ্রুতি রয়েছে, এটি প্রায় পৌনে ২০০বছর আগের। সে সময়কার জমিদার বাড়িতে হাতির পানিরপাত্র হিসেবে ব্যবহার হতো। বর্তমানে এ কড়াইটি নিয়ে মানুষের কৌতুহলের শেষ নেই।

ঢাকাটাইমসের সঙ্গে ‘হাতির কড়াই’ নিয়ে কথা বলেছেন হাজী এমদাদুল হক। পূর্বপুরুষদের স্মৃতিচারণ করে তিনি জানান, প্রায় ১৭৫বছর আগে তার বাবার বড় ভাই মরহুম ভুল্ল্যা মামুদ সরকার এটি ভারতের শিলিগুড়ি থেকে কিনে এনেছিলেন। ভুল্ল্যা মামুদ সরকার তহশিলদার ছিলেন। তার দুটি হাতি ছিলো। হাতি দুটিকে পানি খাওয়ানোর পাশ্ববর্তী দেওনাই নদীতে নিলে তারা উঠতে চাইতো না। তাই হাতি দুটিকে পানি খাওয়ানোর জন্য তিনি লোহার তৈরি এ কড়াইটি কিনেন। যুগের পরিবর্তনে হাতি না থাকলেও এখনো সেই কড়াইটি ঐতিহ্য বহন করে আসছে।

কড়াইটির বিষয়ে ভুল্ল্যা মামুদ সরকারের নাতি ইকবাল বিন এমদাদ বলেন, বাবার মুখে শুনেছি, এটি ‘হাতির কড়াই’। আমার দাদার বাবার দুইটা হাতি ছিল। বাড়ির পাশের দেওনাই নদীতে হাতি দুটোকে পানি খাওয়ানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হতো। কিন্তু পানি খাওয়ার পর নাকি হাতি আর বাড়ি ফিরতে চাইতো না। এ কারণে ভারতের শিলিগুড়ি থেকে কড়াইটি কিনে নিয়ে আসেন। পরে ওই কড়াইতে হাতিকে পানি খাওয়ানো হতো। এখন হাতি নেই কিন্তু কড়াইটা আছে। বাপ-দাদার পুরনো ঐতিহ্য হিসেবে আমার বাবা এটি সংরক্ষণ করে রেখেছে। এই কড়াইটার জন্য এখন আমাদের এলাকাও বেশ পরিচিত।

তিনি আরও বলেন, কড়াইটি ভালোভাবে সংরক্ষণে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছি। ঝড় বৃষ্টি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে যাতে এটি নষ্ট বা ধ্বংস না হয়, সেটারও ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আমাদের বংশের কারণে এলাকার নাম তহশিলদারপাড়া। এই নাম এবং কড়াইয়ের সাথে আমাদের এবং এলাকার একটা ঐতিহ্য ও স্মৃতি জড়িয়ে আছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর জাদুঘরে রাখার জন্য কড়াইটি চেয়েছিল, কিন্তু এটা তো আমাদের ব্যক্তিগত সম্পদ।

তাদের পরিবারের লোকজনের দাবি, কড়াইটি সরকারি কিংবা কোনো রাজা-বাদশার কীর্তি নয়, এটা তাদের বংশের ঐতিহ্য। এই কড়াইটির নামে এখানে মসজিদ ও মাদরাসা রয়েছে। গ্রামটির নামকরণও হয়েছে। পুরনো ঐতিহ্যের হাতির কড়াইটি এখন জাদুঘরে নেওয়ার জন্য এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী ষড়যন্ত্র শুরু করে দিয়েছে বলেও অভিযোগ তাদের।

পার্শ্ববর্তী হাজীপাড়া এলাকার নাঈম চৌধুরী বলেন, কড়াইটা অনেক পুরাতন। এটার জন্য এলাকার সুনাম ছড়িয়েছে। এলাকার নামটাও হাতির কড়াই নামে পরিচিতি পেয়েছে। বিভিন্ন লোকজন বিভিন্ন জায়গা থেকে এই হাতির কড়াই দেখার জন্য আসে। এটা এলাকাতেই সংরক্ষণ করলে ভালো হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হাতির কড়াই সম্পর্কে জানতে পারবে।

তহশিলদারপাড়ার বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম বলেন, এখন হাতি নাই তো কী হইছে? আমাদের এলাকায় হাতির পানি খাওয়ানোর জন্য বড় লোহার কড়াইটা আছে। এই কড়াইটি এখন আমাদের গ্রামের ঐতিহ্য বহন করছে। এখানকার মানুষ যে একসময় হাতি পুষত, তার প্রমাণ এটি।

এমদাদুলের বাড়িতে কাজ করেন ইব্রাহীম খলিল। তিনি বলেন, কড়াইটা সবসময় আমি দেখাশোনা করি। ময়লা-আর্বজনা, বৃষ্টির পানি, গাছের পাতা পড়লে তা পরিষ্কার করি। বিভিন্ন জায়গা থেকে এই কড়াইটা দেখার জন্য মানুষ আসছে। বর্তমানে এই এলাকা ‘হাতির কড়াই’ নামে পরিচিত। আমরাও বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে গেলে ধর্মপাল হাতির কড়াই জলঢাকা থানা ঠিকানা বলে থাকি।

এবিষয়ে রংপুর জাদুঘরের কাস্টডিয়ান হাবিবুর রহমানের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, কড়াইটি জাদুঘরে সংরক্ষণের বিষয়ে আমাদের প্রধান কার্যালয় থেকে একটা চিঠি এসেছিল। সেই চিঠি নীলফামারী জেলা প্রশাসক বরাবর জমা করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত পরবর্তী পদক্ষেপ বা করণীয় সম্পর্কে তারা আমাদের কিছু জানায়নি।

কড়াইটি ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংরক্ষণে কোনো বাধা আছে কি না, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, লোহার কড়াইটি ১০০বছরেরও বেশি পুরোনো। আর ১০০বছর হলে সেটিকে আমরা প্রত্নতত্ত্ব বস্তু বা সম্পদ বলে থাকি। তখন এসব আর কারো ব্যক্তিগত সম্পদ থাকে না। এটি রাষ্ট্রীয় সম্পদ হয়ে যায়। এখন ওই কড়াইটিও ব্যক্তিগতভাবে সংরক্ষণের কোনো সুযোগ নেই।