• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

মাছের কৃত্রিম প্রজননে গবেষণায় সফলতা: ফিরছে বিলুপ্তপ্রায় মাছ

– নীলফামারি বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১৫ এপ্রিল ২০২৩  

 
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘে (আইইউসিএন) ২০১৫ সালের বিপন্নের তালিকায় নাম পাওয়া যায় বাংলাদেশের সুস্বাধু মাছ জারুয়ার। দেশের উত্তর জনপদে মাছটি ‘উত্তি’ নামে পরিচিত ছিল। এক সময় উত্তরের তিস্তা ও আত্রাই নদীতে জাল ফেললেই মিলতো মিঠা পানির এই মাছ। তবে দিনের পর দিন কমেছে সেই পরিমাণ।

বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় ওঠার ৩ বছর পর ২০১৮ সালে জারুয়া মাছ নিয়ে গবেষণা শুরু করে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট স্বাদুপানি উপকেন্দ্র, সৈয়দপুর। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর গত বছরের ডিসেম্বরে এই মাছের কৃত্রিম প্রজননে সফলতা পান কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিকরা। সর্বশেষ পঞ্চম বারের মতো সফলভাবে এর প্রজনন ঘটাতে সক্ষম হন চলতি মাসে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট সৈয়দপুর স্বাদুপানি উপকেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, দিনাজপুরের খানসামা অঞ্চল থেকে মাছ সংগ্রহ করে উপকেন্দ্রটির পুকুরে অভ্যস্ত করে সিনথেটিক হরমোন প্রয়োগ করে কৃত্রিম প্রজনন ঘটানো হয়। হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগের ১৮-২০ ঘণ্টা পর স্ত্রী মাছকে চাপ প্রয়োগ করে ডিম বের করা হয় এবং পুরুষ মাছের স্পার্ম বের করে ০.৯% লবণ পানির সঙ্গে মিশিয়ে দ্রবণ তৈরি করা হয়। উক্ত দ্রবণ ডিমের সঙ্গে মিশিয়ে পাখির পালক দিয়ে ২-৩ মিনিট নাড়ানো হয় এবং ফ্রেশ পানি দিয়ে ধুয়ে ট্রেতে কৃত্রিম ঝর্ণায় স্থানান্তর করা হয়। এর পর ৮৪-১০০ ঘণ্টার বেশি নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও গবেষণায় সফল হয় প্রজনন প্রক্রিয়া৷ তবে এই অঞ্চলের পানিতে আয়রনের পরিমাণ বেশি থাকায় পোনা উৎপাদনে সময় লাগছে বেশি।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, ইনস্টিটিউট কর্তৃক গবেষণালব্ধ কৌশল অনুসরণ করলে ব্যক্তি মালিকানাধীন ও সরকারি মৎস্য হ্যাচারিসমূহে জারুয়া মাছের পোনা প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। জারুয়া মাছের কৃত্রিম প্রজনন সম্প্রসারণ করা গেলে চাষের মাধ্যমে দেশে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতিটির উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে এবং বিপদাপন্ন অবস্থা থেকে এ প্রজাতিকে সুরক্ষা করা যাবে। সেইসঙ্গে ছোট মাছ হওয়ায় রংপুরের ১৩ শতাংশ ঘাটতি মেটাতে পারবে বলে আশাবাদী বিজ্ঞানীরা।

কেন্দ্রটির বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শ্রীবাস কুমার শাহা বলেন, মাছটির প্রজনন ঘটানোর জন্য আমাদের কিছু ফরমুলা প্রয়োগ করতে হয়। কয়েকটি ধাপে আমরা সম্পূর্ণ বিষয়টি সফল করি। দীর্ঘ সময় ধরে এটিকে পর্যবেক্ষণ করতে হয়। বলতে পারেন ৮০-১১০ ঘণ্টা একটি শ্বাসরুদ্ধ সময় কাটে। তবে বিপুপ্তপ্রায় মাছটি উদ্ধারে কাজ করতে পেরে আমরা গর্বিত।

ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মালিহা জাহান মৌ জানান, দেশের উত্তর জনপদে মাছটি উত্তি নামে পরিচিত। মিঠাপানির জলাশয় বিশেষ করে পাথুরে তলদেশ ও অগভীর স্বচ্ছ নদীতে এদের আবাসস্থল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। মাছটি সুস্বাদু, মানবদেহের জন্য উপকারী অণুপুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ এবং উত্তরাঞ্চলে খুবই জনপ্রিয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এক সময় মাছটির প্রাচুর্যতা ছিল। এটি মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণে বড় অবদান রাখবে বলে আমরা আশাবাদী।

বাংলাদেশ মৎস গবেষণা ইনস্টিটিউট সৈয়দপুর স্বাদুপানি উপকেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও কেন্দ্র প্রধান ড. আজহার আলী বলেন, বিপন্নের তালিকার একদম রেড জোনে আছে জারুয়া মাছ। পরিবেশের অবস্থা ও ড্রাই সিজনে নদীতে পানি না থাকায় যেকোনো সময় এই মাছটি প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হতে পারে। আর এই বিলুপ্ত দশা থেকে মাছটি রক্ষা করতে আমরা ২০১৬ সাল থেকে সৈয়দপুরে গবেষণা শুরু করি। চলতি বছরে আমরা সফলতা পেয়েছি।

‘মাছটি আমরা দিনাজপুরের জয়গঞ্জ থেকে সংগ্রহ করতে সক্ষম হই। গবেষণা করে দেখি যে এটি শীতকালীন বিডার। আমরা শীতকালে বিভিন্ন প্রকার হরমোন প্রয়োগ করে গবেষণা চালাই। এক পর্যায়ে সফলতা পাই।’

তিনি আরও বলেন, দেশের আমিষের চাহিদার ১৩ শতাংশ ঘাটতি কিন্তু রংপুরে। যেহেতু এটি ছোট মাছ, সাইজে ছোট। সেক্ষেত্রে আমাদের এই ঘাটতি পূরণে মাছটি অনেক বড় অবদান রাখবে। ইনস্টিটিউট কর্তৃক গবেষণালব্ধ কৌশল অনুসরণ করলে ব্যক্তি মালিকানাধীন ও সরকারি মৎস্য হ্যাচারিসমূহে জারুয়া মাছের পোনা প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

জারুয়া মাছসহ বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, স্বাদুপানি উপকেন্দ্র সৈয়দপুরে কৃত্রিম প্রজননকৃত মোট মাছের সংখ্যা ১১টি। ২০০৬ সালে উপকেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠার পর ২০১৬ সালে প্রথম টেংনা মাছের কৃত্রিম প্রজননে সফল হন বিজ্ঞানীরা। এরপর ২০১৭ সালে গুটোমো খলিশা, ২০১৯ লৈচা টেংনা ও বালা চাটা, ২০২০ সালে বৈরালি ও আংগুস, ২০২০ সালে মোটিয়াপুইস এবং ২০২২ সালে ন্যারিকেল চ্যালা মাছের প্রজননে সফল হয় কেন্দ্রটি। প্রজননকৃত ১০ মাছের কিছু কিছু মাঠ পর্যায়ে চাষে সফলতা পেয়েছেন মৎস্য বিজ্ঞানীরা। এছাড়াও তিস্তা নদীর জলজ ও জীববৈচিত্র্যের বর্তমান অবস্থা নিয়েও গবেষণা করছেন প্রতিষ্ঠানটির বিজ্ঞানীরা।