• শুক্রবার ০৩ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২০ ১৪৩১

  • || ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫

হাতি নেই তবুও ২০০ বছর শিকলে বাঁধা ‘হাতির কড়াই’

– নীলফামারি বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৫ নভেম্বর ২০২৩  

বাড়িতে হাতি নেই। অথচ হাতির জন্য রয়েছে মস্ত বড় একটা কড়াই। সেটাও আবার শিকলে বাঁধা। দাবি করা হচ্ছে, কড়াইটি পূর্বপুরুষদের প্রায় ২০০ বছরের ঐতিহ্য। শুধুমাত্র হাতিকে পানি পান করানোর জন্যই এই কড়াইটি ভারত থেকে আনা হয়েছিল। সম্প্রতি কড়াইটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নিদর্শনের স্বীকৃতিও পেয়েছে।

প্রায় দুইশ বছরের স্মৃতিমাখা লোহার কড়াইটি সংরক্ষণে জাদুঘরে নিতে চেয়েছে প্রশাসন। তাদের এই উদ্যেগে আপত্তি তুলেছেন কড়াইটির দাবিদাররা। নিজেদের কাছে রেখে এটিকে উন্মুক্ত করে দিতে চান কড়াইটির দাবিদাররা। স্থানীয়রাও কড়াইটি হাতছাড়া করতে চাইছেন না। কড়াই রক্ষার দাবিতে এলাকাবাসী মানববন্ধনের মতো কর্মসূচিও পালন করেছেন।

ঐহিত্য বহনের এ কড়াইটির সন্ধান মিলেছে নীলফামারীর জলঢাকায়। কড়াইটি উপজেলার ধর্মপাল ইউনিয়নের তহশিলদাপাড়া এলাকায় রয়েছে। সেখানকার বাসিন্দা হাজী এমদাদুল হকের বাড়ির আঙিনায় শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে এই কড়াই। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই কড়াইটি দেখার জন্য আসছেন।

লোহার কড়াইটি ৭ ফিট ব্যাসের। ওজন প্রায় এক টন। উচ্চতা প্রায় সাত ফুট। ২৮ মণ ১০ কেজি আধাপোয়া ওজনের এ কড়াইটি ভারত থেকে কেনা। জনশ্রুতি রয়েছে, এটি প্রায় ২০০ বছর আগের। সে সময়কার জমিদার বাড়িতে হাতির পানিরপাত্র হিসেবে ব্যবহার হতো। বর্তমানে এ কড়াইটি নিয়ে মানুষের কৌতুহলের শেষ নেই।

‘হাতির কড়াই’ সম্পর্কে এমদাদুল হক পূর্বপুরুষদের স্মৃতিচারণ করে তিনি জানান,  প্রায় ১৭৫ বছর আগে তার বাবার বড় ভাই মরহুম ভুল্ল্যা মামুদ সরকার কড়াইটি ভারত থেকে কিনে এনেছিলেন। ভুল্ল্যা মামুদ সরকার তহশিলদার ছিলেন। হাতিকে পানি পান করানোর জন্য তিনি লোহার তৈরি এ কড়াইটি কেনেন। যুগের পরিবর্তনে হাতি না থাকলেও এখনো সেই কড়াইটি ঐতিহ্য বহন করে আসছে।

কড়াইটির বিষয়ে ভুল্ল্যা মামুদ সরকারের নাতি ইকবাল বিন ইমদাদ বলেন, বাবার মুখে শুনেছি, এটি ‘হাতির কড়াই’। আমার দাদার বাবার দুইটা হাতি ছিল। বাড়ির পাশের দেওনাই নদীতে হাতি দুটোকে পানি পান করানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হতো। কিন্তু পানি পান করার পর নাকি হাতি আর বাড়ি ফিরতে চাইতো না। এ কারণে ভারতের শিলিগুড়ি থেকে কড়াইটি কিনে নিয়ে আসেন। পরে ওই কড়াইতে হাতিকে পানি পান করানো হতো। এখন হাতি নেই, কিন্তু কড়াইটা আছে। বাপ-দাদার পুরনো ঐতিহ্য হিসেবে আমার বাবা এটি সংরক্ষণ করে রেখেছেন। এই কড়াইটার জন্য এখন আমাদের এলাকাও বেশ পরিচিত।

তিনি আরও বলেন, কড়াইটি ভালোভাবে সংরক্ষণে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছি। ঝড় বৃষ্টি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে যাতে কড়াইটি নষ্ট বা ধ্বংস না হয়, সেই দিকটাও খেয়াল রাখা হচ্ছে। আমাদের বংশের কারণে এলাকার নাম তহশিলদারপাড়া। এই নাম এবং কড়াইয়ের সঙ্গে আমাদের এবং এলাকার একটা ঐতিহ্য ও স্মৃতি জড়িয়ে আছে। প্রত্মত্ত্ব অধিদপ্তর জাদুঘরে রাখার জন্য কড়াইটি চেয়েছিল, কিন্তু এটা তো আমাদের ব্যক্তিগত সম্পদ।

পরিবারের লোকজনের দাবি, কড়াইটি সরকারি কিংবা কোনো রাজা-বাদশার কীর্তি নয়, এটা তাদের বংশের ঐতিহ্য। এই কড়াইটির নামে এখানে মসজিদ ও মাদরাসা রয়েছে। গ্রামটির নামকরণও হয়েছে। পুরনো ঐতিহ্যের হাতির কড়াইটি এখন জাদুঘরে নেওয়ার জন্য এক শ্রেণির মানুষ ষড়যন্ত্র শুরু করে দিয়েছে বলেও অভিযোগ তাদের।

পার্শ্ববর্তী হাজীপাড়া এলাকার নাঈম চৌধুরী বলেন, কড়াইটা অনেক পুরাতন। এটার জন্য এলাকার সুনাম ছড়িয়েছে। এলাকার নামটাও হাতির কড়াই নামে পরিচিতি পেয়েছে। বিভিন্ন লোকজন বিভিন্ন জায়গা থেকে এই হাতির কড়াই দেখার জন্য আসেন। এটা এলাকাতেই সংরক্ষণ করলে ভালো হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হাতির কড়াই সম্পর্কে জানতে পারবে।

ইব্রাহীম খলিল নামে এক ব্যাক্তি বলেন, কড়াইটা সবসময় আমি দেখাশোনা করি। ময়লা-আর্বজনা, বৃষ্টির পানি, গাছের পাতা পড়লে পরিষ্কার করি। বিভিন্ন জায়গা থেকে এই কড়াইটা দেখার জন্য মানুষ আসছেন। বর্তমানে এই এলাকা ‘হাতির কড়াই’ নামে পরিচিত। আমরাও বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে গেলে ধর্মপাল হাতির কড়াই জলঢাকা থানা ঠিকানা বলে থাকি।

রংপুর জাদুঘরের কাস্টডিয়ান হাবিবুর রহমান বলেন, কড়াইটি জাদুঘরে সংরক্ষণের বিষয়ে আমাদের প্রধান কার্যালয় থেকে একটা চিঠি এসেছিল। সেই চিঠি নীলফামারী জেলা প্রশাসক বরাবর জমা করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত পরবর্তী পদক্ষেপ বা করণীয় সম্পর্কে তারা আমাদের কিছু জানায়নি।

কড়াইটি ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংরক্ষণে কোনো বাধা আছে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, লোহার কড়াইটি ১০০ বছরেরও বেশি পুরোনো। আর ১০০ বছর হলে সেটিকে আমরা প্রত্মতত্ত্ব বস্তু বা সম্পদ বলে থাকি। তখন এসব আর কারো ব্যক্তিগত সম্পদ থাকে না। এটি রাষ্ট্রীয় সম্পদ হয়ে যায়। এখন ওই কড়াইটিও ব্যক্তিগতভাবে সংরক্ষণের কোনো সুযোগ নেই।