• মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ৫ ১৪৩০

  • || ০৮ রমজান ১৪৪৫

একজন মানবিক নেত্রী ও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন

– নীলফামারি বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৬ আগস্ট ২০২১  

ড. কাজী এরতেজা হাসান

২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। তখন এক সেনা কর্মকর্তা তার অধীন জওয়ানদের নির্দেশ দিয়েছিলেন এভাবে, ‘যা দেখবে, যা শুনবে, সব লক্ষ্য করেই গুলি চালাবে।’ আরেক কর্মকর্তার নির্দেশ ছিল এমন, ‘ছেলে-বুড়ো যাকে দেখবে, তাকেই হত্যা করবে।’ সেনাসদস্যরা যে ওই সব নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন, তার প্রমাণ বিশ্ব দেখেছিল পরের কয়েক মাসে। হতাহতের সংখ্যা জানা যায়নি, হয়তো কোনো দিন জানা যাবেও না; কিন্তু ভিটেমাটি ছেড়ে প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে লাখ লাখ রোহিঙ্গা।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট ‘গণহত্যা দিবস’ হিসাবে পালন করার ঘোষণা দিয়েছিল রোহিঙ্গারা। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পরের বছর ২০১৮ সালে রোহিঙ্গারা  ‘২০১৭ সালের ২৫ আগস্টকে সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই সময় এই সংক্রান্ত কিছু লিফলেট, পেস্টুন ও ব্যানার নিয়ে প্রচারণা করা হচ্ছে ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশ (রোহিঙ্গা মুক্ত কর মোর্চা) নামের একটি সংগঠন। 

ঘোষণাপত্রে উল্লেখ হয়েছে, ৮০ দশকে মিয়ানমারের উত্তর প্রদেশ রাখাইনে সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গা নাগরিকদের নাগরিকত্ব বাতিল করে নিপীড়ন চালিয়ে আসছে মিয়ানমার সরকার। নানা অজুহাতে ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবরের পর ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাতে রোহিঙ্গাদের উপর ভয়াবহ নির্যাতন শুরু হয়। এরপর থেকে দিনের পর দিন হত্যা, ধর্ষণ ও আগুনে পুড়িয়ে মারাসহ গণহত্যা শুরু করে। এই গণহত্যাকে বিশ্বের অগ্রগণ্য পন্ডিত অধ্যাপক অমর্ত্য সেন ও হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মরত এবং অর্থনীতিতে নোবেল জয়ী জেসমন্ডু টুটু মিয়ানমারের রাখাইনে সংগঠিত ঘটনাকে গণহত্যা (জেনোসাইড) হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। এ কারণে আমরা তাদের (রোহিঙ্গারা) সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে গণহত্যা দিবস হিসাবে সম্পূর্ণরূপে স্বীকৃতি প্রদান করার কথা জানানো হয়। এরপরের ইতিহাস সবারই জানা। 

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর পররাষ্ট্রনীতিতে বিশ্বের নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছিলেন। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সমগ্র বিশ্বের শরণার্থী, সেই সঙ্গে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য যে মানবিকতা দেখিয়েছেন তা বিশ্ববাসীর কাছে একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে। আজ বিশ্বদরবারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘মাদার অব হিউমিনিটি’ বা ‘মানবতার মা’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন। নেদারল্যান্ডসের নামকরা ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিন সাময়িকী তাদের প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছিল ‘শেখ হাসিনা : মাদার অব হিউমিনিটি’। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের আশ্রয় দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে লাখ লাখ নির্যাতিত মানুষের জীবন রক্ষা করেছেন।

রোহিঙ্গাদের জন্য সরকার মানবিক সাহায্য সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত করাসহ তাদেরকে প্রত্যাবাসনের জন্য কূটনৈতিক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সংকট নিরসনসহ স্থায়ী সমাধানে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনে পাঁচ দফা এবং ৭৪তম অধিবেশনে চার দফা প্রস্তাব রাখেন। সম্প্রতি, এক লাখের অধিক রোহিঙ্গার জন্য ভাসানচরে তৈরি করা হয়েছে সবচেয়ে বড় আধুনিক অস্থায়ীভিত্তিতে আবাসন ব্যবস্থা। নানা কারণেই সারাবিশ্বে দিন দিন বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। নিজ বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালানো জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাস্তুচ্যুত  মানুষের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। এসব বাস্তুচ্যুতরা বিভিন্ন ক্যাম্পে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এখনও যুদ্ধ-বিগ্রহ, সীমান্ত নীতি, গৃহযুদ্ধ ও জাতিগত বৈষম্যের ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। আর এসব সহিংসতার শিকার হয়ে অনেক মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। আধুনিক এই বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে করুন বিষয় হলো বিশালসংখ্যক একটি জনগোষ্ঠী নিজ ঘর-বাড়ি, দেশ ছেড়ে অন্য কোনো দেশে বাস্তুচ্যুত জীবনযাপন করছে। আর এই বাস্তুচ্যুতরাই সবচেয়ে বেশি সংকটে ভুগছে। বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে রাজনৈতিক, সামরিক, জাতিগত ও মতাদর্শের নানা সংকট মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছে জাতিগত পরিচয় এবং বেঁচে থাকার অধিকার। 

ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশনার ফর রিফিউজিস (ইউএনএইচসিআর) এর মতে, বর্তমানে প্রায় ৮ কোটি মানুষ নিজ ঘর, বাড়ি ছেড়েছে, এমনকি দেশ ছেড়েছে। বাস্তুচ্যুত পরিচয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষ। এসব বাস্তুচ্যুত মানুষের অধিকাংশই বয়স ১৮ বছরের নিচে। এখনও ১ কোটি মানুষের কোনো পরিচয়ই নেই। কোনো দেশই এদের নাগরিক অধিকার ও স্বীকৃতি দিচ্ছে না। তারা যেন এই পৃথিবী নামক গ্রহের কেউ নয়। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। কেননা এই সকল শরণার্থীদের মানবাধিকার রক্ষা করা না গেলে প্রকৃত টেকসই উন্নয়ন কঠিন হয়ে পড়বে। পৃথিবীর অন্যতম অত্যাচারিত এবং নিপীড়িত একটি জাতিসত্তার নাম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধন কোনো নতুন বিষয় না। বিগত চার দশকের বেশি সময় ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাদের পরিকল্পিত আক্রমণ বিশ্ববাসীর অজানা নয়। ১৯৭৮ সাল প্রথম মিয়ানমার থেকে সে দেশের সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসতে শুরু করে এবং আশ্রয় নেয়। তবে সে সময় বিষয়টি সাময়িক মনে করা হলেও এখন তা স্থায়ী সমস্যা হিসেবে বিরাট আকার ধারণ করেছে। সর্বশেষ ২০১৬ সালের অক্টোবর ও ২০১৭ সালের আগস্ট মাস থেকে আবার নতুন করে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণের উদ্দেশ্যে অনুপ্রবেশ করে। বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার উখিয়া, কুতুপালং ও টেকনাফ উপজেলাসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রায় ১১ লাখের অধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান করছে। এ সকল রোহিঙ্গা স্থায়ী ও অস্থায়ী ক্যাম্পে অবস্থান করছে দীর্ঘ ৪ দশক ধরে। এমনকি সারা দেশে রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান করছে বলে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও গবেষণায় এসেছে। বিভিন্ন সময় মিয়ানমারের জাতিগত সহিংসতার কারণে এখনও রোহিঙ্গারা আসছে এদেশে।
যদিও বাংলাদেশ ১৯৫১ সালের জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেনশনে স্বাক্ষরকারীর দেশ নয়, তা সত্ত্বেও বিশ্বের অত্যাচারিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত এইসব মানুষের পাশে সবসময় আছে। যার অন্যতম উদাহরণ আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ সরকার অব্যাহত রেখেছে তার মানবিক সাহায্য সহায়তা আর প্রত্যাবাসনের জন্য। গত ১৮ জুন ২০২১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মিয়ানমার বিষয়ক গৃহীত রেজুলেশনে দেশটির গণতান্ত্রিক সমস্যা, জরুরি অবস্থা, রাজনৈতিক বন্দি, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও আসিয়ানের কেন্দ্রীয় ভূমিকার প্রতি নজর দেওয়া হলেও প্রায় চার বছর ধরে চলমান রোহিঙ্গা সংকট এবং তাদের প্রত্যাবর্তনের  বিষয়টি  সমাধানের জন্য কোন আলোচনা করা হয়নি। জাতিসংঘের উচ্চপর্যায় থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে এমন উদাসীনতা প্রশ্নের উদ্রেক তৈরি করে বটে।

প্রায় চার বছর আগে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সামরিক বাহিনী এবং তাদের দোসরদের জেনোসাইড ও বর্বরতার শিকার হয়ে প্রায় ১ মিলিয়ন রোহিঙ্গা বাংলাদেশের কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। তবে, রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এবং তাদের দোসরদের এ ধরনের বর্বরতা প্রথম নয়। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গাদেরকে তাদের আবাস থেকে উচ্ছেদের নানা প্রচেষ্টা চলমান ছিল। মিয়ানমার ১৯৪৮ সালে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করলেও মাত্র ১৪ বছরের মাথায় ১৯৬২ সালে সামরিক শাসকের কবলে চলে যায়। ১৯৬২ সালের পর মিয়ানমার মাঝে মাঝে গণতন্ত্রের পথে হাঁটলেও, সেটি ছিল শুভংকরের ফাঁকি! সরকার এবং সংসদে কর্তব্যরত সেনাসদস্যের জন্য সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা ছিল। সরকার পরিচালনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর সুবিধা সংবলিত বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দেওয়া ছিল। ২০১১ সালের পর থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারের রাজনৈতিক পুনর্গঠনের ফলে ২০১৫-তে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বিজয় লাভ করে। তবে, সেনাবাহিনী সাংবিধানিকভাবে সংরক্ষিত সংসদের ২৫ শতাংশ আসন নিজেদের জন্য বরাদ্দ রাখে এবং ক্ষমতার বিরাট অংশ ধরে রাখে। এই অর্থে, ১৯৬২ সালের পরে মিয়ানমার কখনও পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্রের স্বাদ পায়নি। সর্বশেষ, ২০২০ সালে ৮ নভেম্বরের অনুষ্ঠিত মিয়ানমারের নির্বাচনে (অনেক বিশেষজ্ঞ এটাকে মিয়ানমারের মুক্ত নির্বাচন হিসেবে অবহিত করেন) সুচির রাজনৈতিক দল এনএলডি সংসদের ৪৭৬টি আসনের মধ্যে ৩৯৬টি আসনে জয়ী হয়। অপরদিকে, সেনাসমর্থিত দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি কেবল ৩৩টি আসনে জয় লাভ করে। এ  সামরিক বাহিনী সমর্থিত দলের ভরাডুবির পর দেশটির সামরিক বাহিনী নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলে এবং ২০২১ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইয়ের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে। মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের প্রধান অং সান সুচি, রাষ্ট্রপতি উইন মিন্ট এবং সুচির রাজনৈতিক দল এনএলডির অনেক নেতাকে গ্রেফতার হোন।

১৯৬২ সালের প্রথম সামরিক জান্তা ক্ষমতায় আসার পর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সেনাবাহিনীর রোষানলে পড়ে। এর চরম বহিঃপ্রকাশ প্রথম দেখা যায় ১৯৭৮ সালে ‘অপারেশন নাগামিন (Operation Dragon King)’ এর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারের অবৈধ অভিবাসী আখ্যা দিয়ে হত্যা, ধর্ষণ, অমানুষিক নির্যাতনের নামে অমানবিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত করে জান্তা সরকার। ১৯৮২ সালে বার্মা নাগরিকত্ব আইনে (Burma Citizenship Law 1982) ১৩৫টি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে নাগরিক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করলেও বাদ দেওয়া হয় ‘রোহিঙ্গা’ জনগোষ্ঠীকে। ‘রোহিঙ্গা’ জনগোষ্ঠীকে ভিনদেশি বিশেষত বাঙালি অবৈধ অভিবাসী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। মিয়ানমারের সরকারের এ ধরনের ন্যাক্কারজনক পদক্ষেপের ফলে রোহিঙ্গারা হয়ে যায় রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী। সবশেষ, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনী  লাখ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর হত্যা, শিশু ও নারী নির্যাতন, বেদম প্রহার, ঘর, বাড়ি স্থাপনা পুড়িয়ে দেওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের অমানবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। এতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। রাখাইন রাজ্যের সংকটের সময়ে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলেও গত প্রায় চার বছরে একজন রোহিঙ্গাও তাদের দেশে ফেরত যেতে পারেননি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার সরকারের মধ্যে ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর ১৯ দফা সংবলিত একটা সমঝোতা দলিল স্বাক্ষরিত হয়। এই দলিলের ৩ নং অনুচ্ছেদে নাগরিকত্বের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। ১৪ নং অনুচ্ছেদে জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাকে প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ায় সংযুক্তের বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়া ১৮ নং অনুচ্ছেদে কফি আনান কমিশনের সুপারিশের মাধ্যমে রাখাইন রাজ্যে সমস্যার সমাধান করা হবে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। এ দলিলটি রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে অন্যতম মাইলফলক হলেও মিয়ানমার সরকার বরাবরই ‘রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী’ শব্দকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছে। তবে, এ চুক্তির আলোকে ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট মিয়ানমার বাংলাদেশ থেকে প্রথম পর্যায়ে সাত ভাগে বিভক্ত করে ৩ হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গাদের নিজেদের দেশে ফেরত নেওয়ার কথা বললেও তা বাস্তবে হয়নি। ২০১৯ সালে গাম্বিয়ার পক্ষ থেকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে আরোপিত মামলা- Application of the Convention on the Prevention and Punishment of  the  Crime  of  Genocide  (The  Gambia  v. Myanmar) করা হয়। ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি ওই মামলার শুনানি শেষে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে সরাসরি কিছু বলা না হলেও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যে, মিয়ানমারের অধিবাসী তা স্পষ্ট। বাংলাদেশ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহলের পক্ষ থেকে বারবার মিয়ানমার সরকারকে ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন’ বিষয়ে বলা হলেও গত চার বছরে একজনও রোহিঙ্গা তাদের দেশে ফেরত যায়নি।  ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের’ বিষয়টি অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অং সান সুচির শাসনামলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি আলোর মুখ দেখেনি। বরং নানা সময়ে অং সান সুচির বৈপরীত্য আচরণ এ সংকটকে আরও ঘণীভূত করে তুলেছিল। ২০২১ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে মিয়ানমারের পট পরিবর্তন হওয়ায় ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে’র বিষয়ে অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে। সরকারের পাশাপাশি রোহিঙ্গা বিরোধী কট্টর গোষ্ঠী ও তাদের অনুসারীদের নানামুখী পদক্ষেপের বিষয়টি রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশেষত চীন, ভারত এবং জাপানের নীরবতা এ সংকটকে বেগবান করে তুলেছে। ১৯৮২ সালের বার্মার নাগরিকত্ব আইন, মিয়ানমারের রাজনৈতিক পটের পরিবর্তন এবং চীন-ভারতের মত রাষ্ট্রের শক্তিশালী ভূমিকা না রাখা রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে বিরাট চ্যালেঞ্জ  হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২০২১ সালের ৩১ মে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার, ইউএনএইচসিআরের দুই জন কর্মকর্তার ভাসানচরের সফরের পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে কোন সুস্পষ্ট বক্তব্য দেননি। এ বছরেরই ১৬ জুন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক ক্রিস্টিন এস বার্গনারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠককালে প্রত্যাবর্তন বিষয়ে জাতিসংঘ স্পষ্ট একটি রোডম্যাপ তৈরির বিষয়টি নজরে আনা হয়। কিন্তু, তা সত্ত্বেও মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মিয়ানমার বিষয়ক গৃহীত রেজুলেশনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া সত্যিই হতাশাজনক। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন’ এর বিষয়ে প্রচেষ্টা চলমান থাকলেও জাতিসংঘ এবং জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর), চীন, ভারতের মত রাষ্ট্রের ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন’ এর বিষয়ে নীরবতা, ১৯৮২ সালের বার্মার নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের কোন উদ্যোগ না নেওয়া, মিয়ানমারের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের বিষয়াদির আলোকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়কে জটিল করে তুলছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, জননেত্রী শেখ হাসিনার কূটনৈতিক সাফল্যে এই রোহিঙ্গা প্রতাবর্তনও শুরু হবে। এক্ষেত্রে আমাদের প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর প্রতিও অনুরোধ থাকবে, বৈশ্বিক এই সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের পাশে থাকুন। জয় হোক মানবতার জননী শেখ হাসিনার। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।