• বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১১ ১৪৩১

  • || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

সর্বশেষ:
যুদ্ধের অর্থ জলবায়ু পরিবর্তনে ব্যয় হলে বিশ্ব রক্ষা পেত- প্রধানমন্ত্রী দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড মেডিকেল কলেজের ক্লাস অনলাইনে নেয়ার নির্দেশ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ‘গণতান্ত্রিক রীতিনীতি না মানলে জনগণই বিএনপিকে প্রতিহত করবে’ লালমনিরহাটে হত্যা মামলায় বিএনপির দুই নেতা কারাগারে

ইসলামে হজের বিধান, তাৎপর্য ও হিকমত

– নীলফামারি বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৮ মে ২০২২  

ইসলামের মৌলিক পাঁচটি ভিত্তির অন্যতম একটি ভিত্তি হলো হজ। যদি কারো মালিকানায় নিত্যপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্র এবং নিজের ও পরিবারের ভরণ-পোষণের খরচের চেয়ে অতিরিক্ত এই পরিমাণ টাকা-পয়সা বা মাল-সম্পত্তি আছে- যা দ্বারা হজে যাওয়া-আসা এবং হজ আদায়কালীন প্রয়োজনীয় ব্যয় এবং হজকালীন সাংসরিক খরচ হয়ে যায়, পবিত্র কোরআন ও হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী তার ওপর হজ পালন করা ফরজ।

হজ প্রত্যেক মুসলমানের ওপর জীবনে একবারই ফরজ হয়। একবার ফরজ হজ আদায়ের পর পরবর্তীতে হজ করলে তা নফল হিসেবে গণ্য হবে। হজের বিধানকে অবজ্ঞাকারী কিংবা অস্বীকারকারী ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যায়।
ইবাদত কয়েক পদ্ধতিতে আদায় করতে হয়। এর মধ্যে একটি হলো আর্থিক ও শারীরিক ইবাদত। আর হজ হলো সেই আর্থিক ও শারীরিক ইবাদতের সমন্বয়। শারীরিক ইবাদত তথা সালাত আদায় করতে করতে আর্থিক ইবাদত তথা যাকাত আদায় করে সর্বশেষে শারীরিক ও আর্থিক সমন্বয় ঘটিয়ে প্রিয় মহামহিয়ান রব আল্লাহ তাআলার নিদর্শন ও তার স্মৃতিবিজড়িত স্থান সমূহে এসে তারই সমীপে নিজেকে সঁপে দেওয়ার জন্যই হজ আদায় করা হয়।   

হজ ফরজ হওয়ার ঘোষণা
পবিত্র কোরআনে কারিমের সূরায় আল ইমরানের ৯৭ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা হজ ফরজ হওয়ার ঘোষনা দেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, 'আল্লাহর জন্য মানুষের ওপর বাইতুল্লার হজ ফরজ করা হলো, তাদের মধ্যে যারা সেখানে যাওয়ার সমর্থ রাখে। এবং যে কেউ উহা উপেক্ষা করল সে জানেরাখুক যে আল্লাহ তা‘আলা ‍বিশ্ববাসীর মুখাপেক্ষী নন।'

হজরত আবু হুরায়রা রা. বলেন একদা রাসূল (সা.) আমাদের উদ্দেশ্যে খুতবা দিয়ে বলেন হে লোক সকলেরা আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য হজ ফরজ করেছেন বিধায় তোমরা হজ করো।জনৈক ব্যক্তি বল্লেন ইয়া রাসূলাল্লাহ আমরাকি প্রতি বছর হজ করবো? এতদা শ্রবণে আল্লাহর নবী চুপ থাকলেন, সে এ কথা তিন বার জিঙ্গেস করলো! অতপর রাসূল সা. বলেন যদি আমি হ্যাঁ বলি তাহলে তোমাদের জন্য বারম্বার হজ করাই ফরজ হয়ে যাবে,কিন্তু এতে তোমরা সক্ষম হবে না।…. (মুসলিম শরীফ ৪১২) 

হজের ফজিলত সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, 'তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ ও ওমরাহ করো।' (বাকারাহ ২/১৯৬) আল্লাহ তা‘আলার আদেশ বিধায় হজ করার দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা খুশি হন।

আবু হুরায়রা (রা.) বলেন রাসূল (সা.) বলেছেন, 'যে ব্যক্তি হজ করে এবং সে হজের সময়ের মধ্যে কোনো অন্যায় ও পাপাচার না করে থাকে তাহলে সে তার হজ শেষে একজন নবজাতক শিশুর মতো গুনাহীন হয়ে ফিরল।' (বুখারী ২৫০৭)  আবু হুরায়রা রা. বলেন, 'রাসূল (সা.) বলেছেন হজে মাবরুরের প্রতিদান শুধুমাত্র জান্নাতই।' (বুখারী ২৫০৮) 

আয়েশা রা. বলেন, 'আমি আল্লাহর নবীর নিকট জিহাদ করার অনুমতি চাইলে আল্লাহর নবী বলেন মহিলাদের জিহাদ হলো হজ করা।' (মেশকাত: ২৫১৪) ইবনে মাসউদ রা. বলেন, 'রাসূল সা. বলেছেন, 'তোমরা হজ ও ওমরার মাঝে অনুগামী হও; কেননা এই দুইটা দারিদ্রতা ও গুনাহ এমনভাবে মিটিয়ে দেয় যেমনভাবে হাপর লোহা, স্বর্ণ ও রুপার ময়লা দূর করে দেয়।' (মেশকাত ২৫২৪) ইবনে ওমর রা. বলেন, 'আল্লাহর প্রতিনিধি দল তিনটি; গাজি, হাজী ও ওমরাকারী। (মেশকাত ২৫৩৭) 

হজ ফরজ হওয়ার শর্ত সমূহ-
১. মুসলিম হওয়া।
২. স্বাধিন হওয়া।
৩. জ্ঞান সম্পন্ন হওয়া।
৪. প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া।
৫. অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ভালো ও সুস্থ থাকা।
৬. আসা ও যাওয়ার পূর্ণ অর্থ-সম্পদ থাকা।
৭. আসা যাওয়ার মধ্যকার রাস্তার নিরাপত্তা থাকা।
৮. যাওয়া থেকে নিয়ে আসা পর্যন্ত সময়ের। ৯. পরিবারস্থ সকলের খাবার-দাবার ও ১০.যাবতীয় আসবাবের ব্যবস্থা থাকা।
১১. মহিলাদের জন্য তাদের মাহরাম থাকা।

হজ কার ওপর ফরজ?
যার ‍নিকট মক্কা শরীফ যাওয়া ও হজ করে ফিরে আসা পর্যন্ত পরিবারের সাভাবিক খরচ-খরচা ও নিজের মক্কায় আসা যাওয়ার মোটামুটি খরচ পরিমাণ সম্পদ আছে এমন ব্যক্তির উপর হজ করা ফরজ।

হজ আদায় করার সময়
হিজরী বর্ষের শেষ তিন মাস তথা শাওয়াল, জিলকদ এবং জিলহজকে হজের মাস বলা হয়। তবে ৮ থেকে ১২ জিলহজ পর্যন্ত পাঁচ দিন হজের মূল সময়। ১৩ জিলহজেও কিছু মুস্তাহাব আমল রয়েছে। হজের সময় সম্পর্কে কোরআনে ইরশাদ হয়েছে- 'নির্দিষ্ট কয়েকটি মাসকে হজের মাস বলা হয়। যে ব্যক্তি এ মাসগুলোতে হজ আদায় করার নিয়ত করবে, তার জন্য স্ত্রীর সঙ্গে মিলামিশা করা, অশোভনীয় কোনো কাজ-কর্ম করা এবং ঝগড়া-বিবাদ করা জায়েয নয়। আর তোমরা সৎ কর্ম যা কিছুই করো, তা আল্লাহ তা’আলা অবশ্যই জানেন। আর হজে গমন করার সময় পাথেয় সঙ্গে করে নিয়ে যাও। নিশ্চয় সর্বোত্তম পাথেয় হলো তাকওয়া। সর্বোপরি তোমরা আমরা আমাকে ভয় করতে থাকো হে বুদ্ধিমান লোকেরা।' (সূরা বাকারা-৯৭)

হজের প্রকার সমূহ
হজ সর্বমোট তিন প্রকার- ইফরাদ, তামাত্তু ও কিরান।

হজে ইফরাদ: মীকাত থেকে শুধু হজ পালনের উদ্দেশ্যে ইহরাম বেঁধে হজ সম্পাদন করাকে হজে ইফরাদ বলে।

হজে তামাত্তু: হজের মাসসমূহে (শাওয়াল, যিলকদ, যিলহজ) মীকাত থেকে উমরাহ’র নিয়তে ইহরাম করে, উমরাহ পালন করে চুল কেটে বা চেঁছে ইহরামমুক্ত হয়ে যাওয়া। অতঃপর এই সফরেই হজের ইহরাম বেঁধে হজ পালন করা এবং কুরবানী করা। এই পদ্ধতিতে উমরাহ এবং হজ আদায় করাকে হজে তামাত্তু বলে।

হজে কিরান: হজের মাসসমূহে একই সঙ্গে উমরাহ ও হজ পালনের নিয়তে ইহরাম করে উমরাহ সম্পন্ন করার পর হালাল না ওই ইহরামেই হজ করা এবং কুরবানী করা।

হজের তাৎপর্য ও হিকমত
শরীয়তের প্রতিটি বিধানের একটা রহস্য ও তাৎপর্য থাকে। এ তাৎপর্যের গুরুত্ব আছে বলেই বান্দার ওপর এ বিধান আরোপ করা হয়ে থাকে। কোনো কোনো ইবাদতে দৈহিক, কোনো ইবাদতে আত্মিক গুরুত্বকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। আবার কোনো ইবাদতে ব্যক্তিগত ও সামাজিক, আবার কোনো কোনো ইবাদতে অর্থনৈতিক গুরুত্বকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনোটিতে দৈহিক ব্যক্তিগত এবং অর্থনৈতিক গুরুত্বের সমাবেশ ঘটিয়ে মানব জীবনের বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ তথা দৈহিক ও আত্মিক সাধনার সমন্বয় করা হয়েছে। হজ হলো দৈহিক ও অর্থনৈতিক উভয়টির সমন্বয়ে গঠিত এক মহা ইবাদত। 

হজ আদায় করার সময় মানুষের শরীর ও মনের কুরবানীর সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক কুরবানীও দিতে হয়। আল্লাহ তা’আলার অপার অনুগ্রহে প্রাপ্ত অর্থ সম্পদ আল্লাহর পথে খরচ করার মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলার প্রতি আনুগত্য এবং অর্থ-সম্পদের মোহ থেকে নিজেকে পবিত্র করার লক্ষ্যে হজের গুরুত্ব অপরিসীম।

ইবাদতে দৈহিক সাধনা তথা সালাত আদায় করতে করতে এক ধাপ উন্নীত হয়ে সিয়াম আদায় করে আত্মিক সাধনায় বান্দা আল্লাহ তা’আলার বিশেষ নৈকট্যে উন্নতি লাভ করে। দৈহিক ও আত্মিক সাধনায় সফল হওয়ার পরে পরবের্তী পর্যায়ে সে আরেক সাধনার সম্মুখীন হয়, যা তাকে সফলতা ও সম্মানের সর্বোচ্চ শিখরে নিয়ে যেতে সহায়তা করে। তা হলো অর্থনৈতিক সাধনা। যাকাত আদায় করার মাধ্যমে বান্দা এ সাধনা করে। সর্বশেষে বিশেষ নৈকট্যে উন্নীত হওয়ার পরে দয়াময় রব আল্লাহ তা’আলার নিদর্শন সমূহ প্রত্যক্ষ করে সাধনা ও নৈকট্যের সর্বোচ্চ স্তরে সে উপনীত হয়। এর জন্য তাকে দৈহিক ও অর্থনৈতিক সাধনার সমন্বয় ঘটাতে হয়। আর তা সংঘটিত হয় হজ আদায় করার মাধ্যমে। হজ আদায় করার মাধ্যমে সর্বশেষ ও সর্বোচ্চ সাধনা করে বান্দা আল্লাহ তা’আলার নিদর্শন লাভ করে। এ পর্যায়ে নিদর্শন সমূহ প্রত্যক্ষ করার ফলে পার্থিব জগতে প্রেমাস্পদ ও প্রেমিকের সাক্ষাত ঘটে। এটাই হলো হজের হাকীকত ও তাৎপর্য।