• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

সর্বশেষ:
মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা ইতিহাসে অনন্য: রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিরা হস্ত‌ক্ষেপ করবে না: ওবায়দুল কাদের লালমনিরহাটে যুবলীগ কর্মীর পায়ের রগ কাটলেন যুবদল নেতা বাসার ছাদ থেকে পড়ে যুবকের রহস্যজনক মৃত্যু ঠাকুরগাঁওয়ে ঈদ-নববর্ষে ১০ জন নিহত, আহত ২ শতাধিক

ইসলামে সড়ক ও পরিবহন নীতিমালা

– নীলফামারি বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৯ ডিসেম্বর ২০১৯  

ইসলাম জীবনের অন্যান্য বিষয়ের ন্যায়, সড়কে চলাচল ও চলাচলের বাহন সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়নে কোনরুপ ত্রুটি করেনি। তবে ফকিহগণ ইসলামের সড়ক ও পরিবহন আইন নিয়ে যখন গবেষণা করেছিলেন, তখন বর্তমানের ন্যায় এত দ্রুতগামী গাড়ি ছিল না। তখন যাতায়াত করা হত ঘোড়া, গরুর গাড়ি বা উটের ওপর আরোহন করে। তবে সেই নীতিমালাগুলো সামনে রেখে আমরা বর্তমান কালের এ-সংক্রান্ত নীতিমালা তৈরি করতে সক্ষম হব। নিম্নে মৌলিক কিছু নীতিমালা আলোচনা হলো।

কারো ক্ষতি করা বা ক্ষতির কারণ হওয়া উভয়টি হারাম:
নিজে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া বা অন্য কারো ক্ষতি করা অথবা ক্ষতির কারণ হওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। এ ব্যাপারে নবী করিম (সা.) থেকে হাদিসও বর্ণীত হয়েছে। শুধু হারাম করেই ইসলাম থেমে থাকেনি বরং ক্ষতিপূরণ দেয়ারও বিধান জারি করেছে। 

নবী করিম (সা.) বলেন, যে লোক নিজের বাহনের পশুকে মুসলমানদের চলাচলের রাস্তা বা বাজারে দাঁড় করে রাখে এরপর ওর দ্বারা কারো কোনো ক্ষতি হয় তাহলে মালিকের জিম্মাদারি এর ক্ষতিপূরণ দেয়া। (সুনানে দারেমি)। উক্ত হাদিসের আলোকে বলা যায়, ট্রাফিক আইন অমান্য করে রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করে রাখা নিষেধ। এর কারণে কারো কোনো ক্ষতি হলে, ক্ষতিপূরণ আদায় করতেও কোনো সমস্যা নেই।
 
রাস্তায় সকলের চলার অধিকার আছে তবে অন্যকে নিরাপত্তাদানের শর্তে ফকিহগণ এ কথাটাকে একটি মূলনীতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এর সারমর্ম হচ্ছে, রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করা সবার অধিকার। কিন্তু এ অধিকার নি:শর্ত নয় বরং এ অধিকার ভোগ করতে হবে অন্যের কোনো ক্ষতি না করে। তবে নিজকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করার পরও কোনো ক্ষতি হয়ে গেলে সেটা ভিন্ন কথা। 

প্রখ্যাত ফিকহবিত খালেদ আতাসী বলেন, ‘আইন হচ্ছে, মুসলমানদের রাস্তা দিয়ে যাওয়া আসা করা বৈধ তবে অন্যকে নিরাপত্তা দিতে হবে। কেননা, রাস্তা দিয়ে চলাচল করা সবার অধিকার। এতএব, প্রত্যেকে নিজের অধিকার সে ভোগ করবে এবং অন্যের অধিকারকে সে সুরক্ষা দেবে। অতএব, চলাচলের বৈধতা শর্তসাপেক্ষ।

অন্যের নিরাপত্তার বিষয়টি ধর্তব্য ওই ক্ষেত্রে বিবেচ্য, যে সকল দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে চলা সম্ভব ছিল। কিন্তু যে দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব নয় বরং অনাকাঙ্খিতভাবে ঘটে সেখানে অন্যের নিরাপত্তার বিষয়টি লঘু হিসেবে ধরতে হয়। কারণ, এ সকল ক্ষেত্রে অন্যকে নিরাপত্তা দেয়ার শর্ত দেয়া হলে কেউ নিজের অধিকার ভোগ করার সাহস পাবে না। কারণ, তখন সকলে যাতায়াত করা থেকে বিরত থাকবে এই ভয়ে যে, কখন জানি অনাকাঙ্খিক কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায় আর এর জন্য আমার শাস্তি ভোগ করতে হবে। 

আমাদের পূর্ববতী ফকিহগণ তাদের সময়ের এ সকল বিষয় নিয়ে আলোচনা করে এ রকম সিদ্ধান্ত দিয়ে গেছেন। যেমন আগের যুগের বাহন ছিল গরু গাড়ি, ঘোড়া ও উট। সেখানে বাহনের সামনের ক্ষতিকে শাস্তিযোগ্য দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করেছেন। কারণ, এর থেকে আরোহী ইচ্ছা করলে বেঁচে থাকতে পারে। আর পেছনে গরু বা উট লাথি দিয়ে ক্ষতি করলে শাস্তিযোগ্য দুর্ঘটনা বিবেচনা করেননি। কারণ, এগুলো নিজেরাই নড়াচড়া করতে পারে। আর পেছনে কাউকে লাথি মারলে মালিকের কিছু করার থাকে না। (শরহে মাজাল্লাহ, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৪৯৪)।

জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে আগের যুগের বাহন ও বর্তমানের মাঝে পার্থক্য:
মৌলিক কথা হচ্ছে, চালকের গাড়ি দ্বারা যত দূর্ঘটনা ঘটবে, সে এর জবাবদিহিতা করবে। কারণ, গাড়ি তার কাছে ব্যবহারের যন্ত্রের মতো। সে ওই যন্ত্র ব্যবহারে নিয়ন্ত্রন করতে সক্ষম। অতএব, গাড়ি দ্বারা যা ঘটবে, সেই এর জবাবদিহিতা করবে। এখান থেকে পূর্বের পশুর বাহন ও বর্তমান জ্বালানির গাড়ির মাঝে একটি পার্থক্য পরিস্কার হয়ে ওঠে। আগের দিনের পশু চালকের নিয়ন্ত্রনে থাকতো না। নিজে নিজেই নাড়াচাড়া করতে পারত। আর বর্তমানের গাড়ি চালক ছাড়া সামান্যও এদিক-সেদিক হতে পারে না। এ জন্য ফকিগণের দৃষ্টিতে পশুর সামনের পা দিয়ে কারো ক্ষতি হলে, চালককে এর ক্ষতিপূরণ দিতে হত। কারণ, সামনের অবস্থা চালকের নিয়ন্ত্রনেই ধরা যায়। আর পেছনের পায়ে কোনো ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণ দিতে হত না। কারণ, পেছনে কাকে কখন কী ক্ষতি করে চালকের তা নিয়ন্ত্রনে না। আর গাড়ির ক্ষেত্রে সামনে বা পেছনে যেদিক দিয়েই ক্ষতি হোক এর ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। কারণ, গাড়ি পেছন দিয়ে নিজে কিছু করার ক্ষমতা নেই।

যে সকল ক্ষেত্রে চালক অপরাধী বা নিরপরাধ হিসেবে বিবেচ্য হবে-

(এক) রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার আগে গাড়ির যন্ত্রপাতি পরীক্ষা না করলে, এরপর রাস্তায় যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে চালক অপরাধী হিসেবে বিবেচ্য হবে। আর যদি গাড়ি রাস্তায় নামানোর পূর্বে যথাযথভাবে যন্ত্রপাতি দেখে রাস্তায় নামায় এরপর হঠাৎ কোনো কারণে নিয়ন্ত্রনের বাইরে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে চালক এক্ষেত্রে অপরাধী বিবেচ্য হবে না এবং ক্ষতিপূরণও দিতে হবে না। এ ব্যাপারে সৌদি আরবের ‘লাজনুতুত দায়িমা লিল বুহুছ ওয়াল ইফতা’ ফতোয়া জারি করেছেন। এর তুলনা দেয়া যায় ওই নীতির সঙ্গে, কোনো পশু দিয়ে যদি পরিবহনের কাজ করানো হয় এবং হঠাৎ নিয়ন্ত্রনের বাইরে গিয়ে ওই পশু যদি কোনো ক্ষতি করে ফেলে তাহলে এর কোনো ক্ষতিপূরণ দিতে হয় না। তো এক্ষেত্রেও তার কোনো ক্ষতিপূরন দিতে হবে না। কারণ এখানে গাড়ি চালকের নিয়ন্ত্রনের বাইরে যাওয়ার পর যা ঘটেছে তা সম্পূর্ণ দুর্ঘটনা; চালকের সঙ্গে যার কোনো সম্পর্ক নেই। যদি তাকে দুর্ঘটনার ঘটক ধরা হয় তাহলে এক্ষেত্রে তার থেকে কোনো সীমাঙ্ঘন না পাওয়ায় তাকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। অতএব, গাড়ি বের করার সময় যদি নিয়ম মাফিক যন্ত্রপাতি দেখে বের করে এবং ট্রাফিক আইন মেনে গাড়ি চালায় তাহলে দুর্ঘটনার জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না। হ্যাঁ যদি কোনো নিয়ম মেনে চলার ক্ষেত্রে গাফলতি প্রকাশ পায় অথবা যন্ত্রপাতি নষ্ট জেনেও গাড়ি নিয়ে বের হয় অথবা দ্রুতগতিতে গাড়ি চালায় তাহলে দুর্ঘটনার জন্য তাকেই দায়ী করা হবে।

(দুই) কোনো চালক যদি ট্রাফিক আইন মেনে গাড়ি চালায়, এরপর হঠাৎ করে কোনো পথচারি গাড়ির সামনে ঝাঁপ দেয় বা দৌঁড় দেয় এবং ড্রাইভার তাকে বাঁচানোর জন্য যথাযথ চেষ্টা করা সত্তেও ওই লোকের কোনো ক্ষতি হয় তাহলে দুর্ঘটনায় শিকার ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ দিতে হবে কিনা, এ ব্যাপারে সৌদি আরবের ইসলামি আইন গবেষণা সংস্থা ‘লাজনাতুত দায়িমা লিল বুহুস ওয়াল ইফতা’ বিভিন্ন দিক সামনে এনে ক্ষতিপূরণ দেয়া বা না দেয়ার ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি। তবে আমার (তকী উসমানি হাফিজাহুল্লাহ) নিকট মনে হচ্ছে, যদি ওই লোক এত কাছ থেকে গাড়ির সামনে ঝাঁপ দেয় যে, নির্ধারিত গতিতে গাড়ি চালানো সত্তেও তাকে রক্ষা করা কোনোভাবেই সম্ভব না এবং এমন স্থানে এই ঘটনা ঘটেছে, যেখানে এ ধরনের কোনো বিপদের সম্ভাবনা পূর্ব থেকে ছিল না তাহলে এই দুর্ঘটনার জন্য চালককে দায়ী করা যাবে না। বরং দুর্ঘটনার জন্য ও নিজেই দায়ী থাকবে। কারণ, যদি ধরে নেয়া হয়, এক লোক আত্মহত্যার জন্য কোনো গাড়ীর সামনে ঝাঁপ দিলো, সেখানেও দায়ী থাকবে চালক। তাহলে এটি একটি অবান্তর বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। কারণ, চালকের এ ব্যাপারে কোনো ইচ্ছাও ছিল না, জানতোও না এবং জায়গাটি দুর্ঘটনা প্রবণও নয় যে, চালক পূর্ব থেকে সতর্ক থাকবে। অন্যদিকে ওই লোক স্বেচ্ছায় দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। তাই উক্ত সুরতে চালককে কোনোভাবেই দায়ী করা যায় না। হ্যাঁ, গতি নিয়ন্ত্রণ, রক্ষার জন্য চেষ্টায় ত্রুটি ইত্যাদি প্রকাশ পেলে চালক দোষ অনুযায়ী দায়ী থাকবে।

(তিন) কোনো গাড়ি সিগন্যালের সামনে, সিগন্যাল ছুটার অপেক্ষায় ছিল, তখন পেছন থেকে কোনো গাড়ি এসে ধাক্কা দিল এবং এর দ্বারা প্রথম গাড়ীর সামনে কোনো লোক বা বস্তুর ক্ষতি হলো তাহলে পেছনের গাড়ি এর জন্য দায়ী থাকবে। সামনের গাড়ি নয়। এর সম সুরতের বিধান ফকিহগণ কিতাবাদিতে উল্লেখ করেছেন যে, এক লোক ঘোড়ার ওপর সওয়ার ছিল, পেছন থেকে অন্যজন ঘোড়াকে খোচা দেয়ার কারণে ঘোড়া লাথি দিয়ে তৃতীয়জনকে ক্ষতিগ্রস্থ করল তাহলে দায়ী থাকবে খোচাদাতা; আরোহী দায়ী থাকবে না। এ ব্যাপারে সৌদি আরবের ইসলামি আইন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘আল লাজনাতুত দায়িমা লিলবুহুসিল ইলমিয়া ওয়া ইফতা’ একটি সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেছেন। অনুরূপভাবে কোনো লোক যদি কাউকে ধাক্কা দিয়ে গাড়ির নিচে ফেলে দেয় তাহলে যে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে সে দায়ী হবে। এগুলো মৌলিক কিছু কথা। এর আলোকে আরো বহু বিষয়ের সমাধান জানা যায়।

ট্রাফিক আইন মেনে চলা ওয়াজিব:
ইসলামের মূলনীতি হচ্ছে, জনস্বার্থে সরকার কোনো আইন করলে, কোরআন-সুন্নাহর সঙ্গে উক্ত আইন সাংঘর্ষিক না হলে তা মেনে চলা জনগণের ওপর ওয়াজিব। আমরা ট্রাফিক আইনকে এই মূলনীতির আলোকে বলতে পারি মেনে চলা ওয়াজিব। তাছাড়া ট্রাফিক আইন অমান্য করে নিজে কিছু সুবিধা ভোগ করা দ্বারা অন্যকে কষ্ট দেয়া হয়। অথচ এর যৌক্তিক কোনো ব্যাখ্যা নেই। ইসলাম এটাকেও নিষেধ করেছে। নবী (সা.) বলেছেন, ‘মুসলমান ওই ব্যক্তি, যার জবান ও হাতের অনিষ্ট থেকে অপর মুসলমান নিরাপদ থাকে।’ তাই শুধু আইন কঠোর করা নয় বরং ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমেও জনগণের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। (সংক্ষেপ)

অনুবাদ: শহীদুল ইসলাম