• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

গ্রামীণ শিল্প ঝিনুকের চুন

– নীলফামারি বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯  

বিয়ে বা যে কোনো মেহমানদারীতে পান-সুপারি একটি অপরিহার্য উপাদান। আর এই পান-সুপারিকে মুখরোচক করতে যে উপাদানটি কার্যকর ভূমিকা রাখে তা হচ্ছে চুন। চুন ছাড়া পান খাওয়ার কথা ভাবাই যায় না। আর পানখেকোদের কাছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে আছে ঝিনুকের চুন বা যুগির চুন।

খাল, বিল, নদী থেকে ঝিনুক কুড়িয়ে, নানা পদ্ধতিতে যারা চুন তৈরি করে তারা হলো যুগি সম্প্রদায় বা চুনারু নামে আখ্যায়িত। এ কারণে পান খাওয়ার এই ঝিনুকের চুনকে যুগির চুনও বলা হয়।

এখনো গাইবান্ধার বিভিন্ন এলাকায় হিন্দু যুগি পরিবার দেখা যায়। তারা তাদের আদি পেশাকে আঁকড়েই জীবিকা নির্বাহ করছেন। আর সরবরাহ করছেন ঝিনুকের চুন।

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি, সুন্দরগঞ্জ, সাদুল্যাপুর ও সদর উপজেলার ঝিনুক থেকে চুন উৎপাদনকারী প্রায় সাড়ে তিন হাজার পরিবার এখনো নানান সংকট নিরসন করে পৈত্রিক পেশাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। কিন্তু নদ-নদী ও খাল-বিলে ঝিনুকের সংখ্যা কমে যাওয়া, চুনাপাথর থেকে তৈরি চুনের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় যুগির চুনের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। এছাড়াও ঝিনুকের চুনের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, আর্থিক সংকটসহ নানা কারণে পেশাদার যুগিরা জীবন জীবিকার তাগিদে পৈত্রিক পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। 

সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউপির বালুয়া বাজাড়ের কাছে জলেরমোড়ের যুগিপাড়া গ্রামটি এই ঝিনুকের চুনের কারিগরদের কারণে এরইমধ্যে চুনের গ্রাম নামেই সর্বাধিক পরিচিতি অর্জন করেছে। এই যুগিপাড়াসহ পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে স্বাধীনতার আগে প্রায় ১৩০টি পরিবারের বসতি ছিল। যারা ঝিনুকের চুন তৈরি করে খুব স্বচ্ছল জীবন যাপন করতো। 

সে সময় নদীবেষ্টিত এ জেলায় ঝিনুক পাওয়া যেত অনেক বেশি। সে জন্য চুন উৎপাদনের পরিমাণও ছিল বেশি। এছাড়া পাথরের চুনের ব্যবহারের প্রচলন তখনো শুরু হয়নি। উৎপাদিত চুন পার্শ্ববর্তী জেলায় পাঠানো হতো। ফলে দাম বেশি পাওয়ায় তখন চুনের কারবার ছিল রমরমা। কিন্তু এখন সে অবস্থা আর নেই।

রামচন্দ্রপুরের যুগিপাড়ায় এখন মাত্র ১৫টি পরিবার তাদের এই চুন তৈরির পেশাকে আঁকড়ে রেখেছে। এসব পরিবারের নারী-পুরুষ উভয়েই চুন তৈরি করেন। যুগিরা ব্রহ্মপুত্র তীরবর্তী বালাসীঘাট, কামারজানি, করতোয়া নদীর বড়দহ ঘাটসহ বিভিন্ন এলাকার জেলেদের কাছ থেকে নদীর ঝিনুক কেনে। মাছ ধরার সময় জালে যে ঝিনুক ওঠে, স্থানীয় ভাষায় সেগুলোকে বলা হয় ‘সিপি’ বা ‘টোকরাই’। জেলেরা এসব যুগিদের জন্যই তা জমা করে রাখে। প্রতি মণ ঝিনুক যুগিরা কেনে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দরে। 

ঝিনুকগুলো গরম পানিতে সিদ্ধ করা হয়। এতে সহজেই খোলসটি খুলে যায়। এরপর যুুুুগি পরিবারের মেয়েরা প্রতিটি ঝিনুক থেকে ভেতরের নরম অংশগুলো বের করে নেয়। যা হাঁস-মুরগির জন্য অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং প্রিয় খাবার হিসেবে হাঁস-মুরগির খামারীদের কাছে বিক্রি হয়।

পরে ঝিনুকের খোলসগুলো পানিতে ধুয়ে রোদে শুকানো হয়। সবশেষে চুনের ভাটিতে আগুনে পুড়িয়ে তা ছাঁই করা হয়। ভাটিতে আগুনের উত্তাপ বৃদ্ধির জন্য সাইকেলের চাকায় তৈরি একটি বিশেষ হাঁপর চালিয়ে ভাটিতে বাতাস দেয়া হয়। ঝিনুক বা টোকরাইয়ের এই ছাঁইগুলো বড় মাটির পাত্রে রেখে তাতে পানি মিশিয়ে বাঁশের লাকড়ি দিয়ে ঘুটিয়ে তৈরি করা হয় পান খাওয়ার চুন। 

গাইবান্ধার রামচন্দ্রপুর ইউপির জলের মোড় যুগিপাড়ার যুগি গোপী লাল বলেন, এক মণ ঝিনুক থেকে দুই মণ চুন হয়। এক মণ ঝিনুকের চুন তৈরি করতে সময় লাগে তিনদিন। এই চুন প্লাস্টিকের ক্যানে করে পানের দোকানে বিক্রি করে প্রতি কেজি ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি করা হয়। 

একই গ্রামের একাধিক যুগি জানান, ঝিনুকের কোমলাংশ এবং চুন বিক্রি করে খরচ বাদে লাভ হয় ৫৮০ থেকে ৬৫০ টাকা। যা দিয়ে তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

এছাড়া পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতায় খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়ায় স্থানীয় নদী-নালা-খাল-বিল থেকে এখন আর সহজেই ঝিনুক পাওয়া যায় না। ফলে জেলার বাইরে থেকেও বেশি দামে ঝিনুক কিনে আনতে হয়। এতে চুনের উৎপাদন খরচ পড়ে অনেক বেশি।

তবে পার্শ্ববর্তী বগুড়াসহ অন্যান্য জেলায় সামুদ্রিক শঙ্খ এবং সাদা রংয়ের ঝিনুক থেকেও চুন তৈরি হচ্ছে। সেখানে শঙ্খ এবং সাদা ঝিনুকও কিনতে পাওয়া যায়। সামুদ্রিক শঙ্খ এবং সাদা ঝিনুক থেকে যে চুন হয় তার রং এমনিতে সাদা। এছাড়াও চুনে এসিড মিশিয়েও সাদা করা হচ্ছে। যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

কিন্তু যুগিদের চুনে কোন কেমিকেল মেশানো হয় না বলে তার রং একটু কালচে হয়। ফলে এই সাদা শঙ্খের চুনের দাম বেশি হলেও প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না যুগিদের বানানো ঝিনুকের চুন। 

জলেরমোড়ের যুগিপাড়ার যুগিরা জানান, তাদের দাবি আর্থিক কারণে তারা আদি এই গ্রামীণ শিল্পের বিকাশ ঘটাতে পারছে না। তাই সহজ শর্তে ঋণ সহায়তা দেয়া হলে তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হবে। এতে তারা এ অঞ্চলের খাল-বিল-নদী-নালা থেকে প্রাপ্ত সাধারণ এই ঝিনুকের চুন শিল্পের বিকাশ ঘটাতে পারবে।