• মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ৫ ১৪৩০

  • || ০৮ রমজান ১৪৪৫

ডিমলা উপজেলার তিস্তার চরাঞ্চলে নারীর ভাগ্য বদলে ডিজিটালের ছোঁয়া

নীলফামারি বার্তা

প্রকাশিত: ৯ মার্চ ২০১৯  

জীবনটা নদীর মতো, কখনও শান্ত কখনও উত্তাল আবার কখনও স্থির কখনও ঝড়। জন লিডগেট বলেছেন, যে নদী গভীর বেশি, তার বয়ে যাওয়ার শব্দ কম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, সমুদ্রের বিশেষ মহিমা এই যে, মানুষের কাজ সে করিয়া দেয়, কিন্তু দাসত্বের চিহ্ন সে গলায় পরে না। ডিমলা উপজেলার তিস্তার চরাঞ্চলের নারীরা স্থির। শব্দহীনভাবে তারা নিজেদের ভাগ্য গড়ে তুলতে গাভী লালন-পালন করে দুগ্ধ উৎপাদনের খামার গড়ে তুলেছে। এমনকি তারা চরের বালু মাটিতে আবাদ করছে বিভিন্ন শাকসবজি। শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশে এ সকল কাজে তারা ব্যবহার করছে তথ্য প্রযুক্তির স্মার্টফোনের সহায়তা। নারীদের নিয়ে কোন দিবস এলে তারা নিজেদের মধ্যে ছোট্ট করে হলেও সেই দিবসটি যথাযথভাবেই পালন করে থাকে।

পালন করে পরিবেশ দিবসও। ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবসেও তারা পিছিয়ে থাকে না। এ নিয়ে তারা এলাকায় র‌্যালি ও সমাবেশের আয়োজন করেছে। দুর্গম এলাকায় তাদের আয়োজন শব্দহীন অবস্থায় রয়ে যায়। চরাঞ্চলের এই নারীদের নিয়েই এই প্রতিবেদনে ভাগ্য বদলের একটুখানি প্রয়াস।

ডিমলা উপজেলা তিস্তা নদী বিধৌত বাংলাদেশের একটি অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ এলাকা। উজান হতে নেমে আসা পানিতে তিস্তায় অকাল বন্যা দেখা দেয়। বন্যার ফলে চরের পতিত জমি এবং আবাদি জমি পানির নিচে ডুবে যায় এবং ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়। এক সময় সবুজ ঘাসের সমারোহ ঘটে। ফলে উপজেলাটিতে ছোট-বড় ৯২টি বিদেশী জাতের গরুর খামারের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে দুগ্ধ খামার। এছাড়া নারীরা চরের জমিতে চাষাবাদ করছে ভুট্টা, মিষ্টি কুমড়া,বাদামসহ বিভিন্ন শাকসবজি।

তিস্তা নদীর ভাঙ্গনে সবকিছু হারিয়ে সর্বশান্ত হয়ে যাওয়া পরিবারগুলো জেগে ওঠা চরে বাসা গড়েছেন। এখানকার বাড়িগুলোর বেশির ভাগ পুরুষ সদস্য অন্যের জমিতে দিন মজুরির কাজ করেন। কেউ কেউ পরিবার-পরিজন রেখে পাড়ি জমিয়েছেন দেশের বিভিন্ন শহরে, যেখানে মৌসুমি শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। সংসারে বাড়তি আয় করতে নারীরা গাভী পালন করছে। এ ছাড়া নারীরা বর্গা নিয়ে এঁড়ে গরুও পালন করে তারা। সেই গরু দিনভর চরাঞ্চলের খোলা মাঠে ঘাস ও লতাপাতা খাইয়ে বড় করে বিক্রি করেন। সেখান থেকে পাওনা টাকা মহাজনকে ক্রয় মূল্য দিয়ে বাকি যে টাকা থাকে তার অর্ধেক নিজেরা রাখেন, বাকি অর্ধেক মহাজনকে দেন। সকাল সকাল পরিবারের সদস্যদের রান্না-বান্না শেষে প্রতিদিন গরু নিয়ে মাঠে যান চরের আছিয়া বেগম (৪০)। দিনভর গরুর পেছনেই কেটে যায় তার। গরু মাঠে নিয়ে যাওয়া এবং দুপুরে ও সন্ধ্যায় বালতি ভরে পানি খাওয়ানো নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তিনি। জানালেন, নিজেদের গরু কেনার টাকা নাই। তাই চারটি গরু বর্গা নিয়েছেন। গত দুই বছরের গরুর লভ্যাংশ দিয়েই এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন তিনি। আছিয়া বলেন, দুই দিকে নদী থাকায় চরে চোর-ডাকাতের ভয় নেই। ভয় শুধু বন্যা আর নদী ভাঙ্গনের কারণে আমরা সর্বশান্ত হয়ে পড়েছি। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ও অক্সফাম ইন বাংলাদেশের সহায়তায় দুর্গম চর এলাকার পিছিয়ে পড়া মানুষদের জীবন মান উন্নয়নে এবং অর্থনৈতিকভাবে সফল নারীদের সফলতা নিয়ে আসছে পল্লীশ্রী রি-কল-প্রকল্প। এতে তিস্তার চরাঞ্চলের নারীদের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটছে।

তিস্তার খগাখরিবাড়ি গ্রামের মেরিনা বেগম দুটি বিদেশী গাভী পালন করছেন। প্রতিদিন তার দুধ উৎপাদন হয় ৯ থেকে ১১ লিটার। বাবুরহাট এলাকার আমিনা ইসলাম তার খামারে ১৯টি বিদেশী গাভী থেকে প্রতিদিন ৯০ লিটার দুধ উৎপাদন হয়ে থাকে। কুমারপাড়ার আজিমুন নেছা খামারের ১৭টি গাভীর প্রতিদিন ৬৫ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। এ রকম আরও অনেক দুগ্ধ খামারি বিভিন্ন পরিবারের হিসাবে দুধ উৎপাদনের কথা জানায়। তারা সকলে বলেন, আমরা তিস্তা নদীর বন্যা ও ভাঙ্গনে এক সময় নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলাম। বেসরকারীভাবে ঋণের মাধ্যমে গাভী পালনে পরিবারভিক্তিক আমরা সকলে খামার গড়ে তুলি। এতে অনেকখানি স্বাবলম্বী হয়ে উঠি। এখন প্রচুর দুধ উৎপাদন করতে গিয়ে আমরা বাজারজাতে সমস্যায় পড়ছি। স্থানীয় হাটবাজারে, হোটেল ও বাসাবাড়িতে প্রতিদিন ১৫ হাজারের ওপর উৎপাদিত দুধ বিক্রি হয় না। আবার দামও কম। লিটার প্রতি ২০ থেকে ২৫ টাকায় দুধ বিক্রি করতে হচ্ছে। এছাড়া উৎপাদিত দুধ বিক্রি না হওয়ায় অনেক দুধ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তারা জানায়, ডিমলায় সরকারী বা বেসরকারী উদ্যোগে কোন দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্র (চিলিং পয়েন্ট) না থাকার কারণে দুধের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা। পল্লী-শ্রীর প্রতীক প্রকল্পের কর্মকর্তা এম.এ মকিম চৌধুরী জানান, আমরা চরাঞ্চলের নারীদের সহযোগিতায় দুই শতাধিক স্মার্টফোন বিনামূল্যে সরবরাহ করেছি। প্রতি মাসে তাদের প্রতিটি মোবাইলে ৫০০ এমবি ইন্টারনেট ও ৩৯ টাকা করে ফ্লেক্সিলোড দিয়ে থাকি।