• মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ৫ ১৪৩০

  • || ০৮ রমজান ১৪৪৫

দুনিয়া ধ্বংস করার চেয়েও বড় অপরাধ, নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা

– নীলফামারি বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১৪ অক্টোবর ২০১৯  

একটা সমাজ যখন অসভ্যতার দিকে এগোতে থাকে, তখন ওই সমাজ থেকে মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটিত হতে থাকে। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি দিয়ে শুরু করা অপরাধকারীরা অন্যায়ের দিকে এগোতে থাকে। 

একসময় সকল অন্যায় আর অপরাধকে পেছনে ফেলে সভ্যতা ও মানবতাবর্জিত অপরাধের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যায়। তখন অপরাধীরা হয়ে ওঠে বেপরোয়া লাগামহীন। শুরু হয় নিরপরাধ মানুষ হত্যা। পৃথিবীর সবচে বড় অন্যায়গুলো অন্যতম অন্যায় হলো নিরাপদ মানুষকে মারা। 

যারা নিরপরাধ মানুষ মারে তখন তারা আর মানুষ থাকে না। হয়ে যায় পশু জানোয়ার। তাবৎ পৃথিবীর মানুষ তাদেরকে ধিক জানায়। শুধু সভ্য সমাজ নয়, পৃথিবীর কোনো ধর্মে সমাজে মতবাদে নিরাপদ মানুষ মারার কোনো বিধান নেই। এক্ষেত্রে ইসলামে সবচে কঠিন ঘোষণা হচ্ছে-
 
أَنَّهُ مَنْ قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الْأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيعً

অর্থাৎ: ‘যে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করল সে যেন পুরো পৃথিবীকে হত্যা করল, আর যে একজন (নিরপরাধ) মানুষকে বাঁচিয়ে দিল সে যেন পুরো পৃথিবীকে হত্যা হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল।’ (সূরা মায়েদাহ : আয়াত নম্বর ৩২)

হাদিসে এসেছে-

أن النبي صلى الله عليه و سلم قال لزوال الدنيا أهون على الله من قتل رجل مسلم

অর্থাৎ: ‘আল্লাহ দুনিয়া ধ্বংস হওয়া সয়ে যাবেন, তবে একজন নিরপরাধ মুসলাম হত্যা সহ্য করবেন না।’ (তিরমিযি হাদিস নম্বর ১৩৯৫)

অন্য হাদিসে আছে-

عن مسلم بن مسعود قال : قال رسول الله صلى الله عليه و سلم لا يحل دم امرئ مسلم يشهد أن لا إله إلا اله وأني رسول الله إلا بإحدى ثلاث الثيب الزاني والنفس بالنفس والتارك لدينه المفارق للجماعة

অর্থাৎ: ‘তিনটি কারণ ছাড়া কোনো মুসলমান অন্য কোনো মুসলমানকে হত্যা করতে পারে না। বিবাহিত নারী পুরুষ যিনা করলে, বিনাদোষে কাউকে কেউ হত্যা করলে ও ধর্ম ছেড়ে বিচ্ছিন্নবাদী হয়ে গেলে।’ (তিরমিযি হাদিস নম্বর: ১৪০২) 

হাদিসের বিখ্যাত কিতাব তিরমিযির একটি বর্ণনা এরকম- দুনিয়া ধ্বংস করার চেয়েও বড় অপরাধ হলো নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা।

আমাদের ইসলাম ধর্ম মানুষকে রক্ষা করার ব্যাপারে খুবই সতর্ক ও হুঁশিয়ার। ইসলামে কখনো কোনো অবস্থাতেই নিরপরাধীকে অপরাধী করার সুযোগ নেই। শুধু হত্যা নয়- অপহরণ, গুম  প্রভৃতি চরমপন্থা অবলম্বনকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আগেকার জাতিসমূহ এসব অন্যায়ের কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে। সাময়িক উত্তেজনা বা সস্তা আবেগের বশবর্তীতে মানুষকে অপহরণ, গুম, খুন, গুপ্তহত্যা, যাত্রীবাহী বাসে অগ্নিসংযোগ, জ্বলন্ত পুড়িয়ে মারা, অপহরণের তিন মাস পড়ে গ্রেফতার দেখানো, ভিন্ন মতাদর্শের বলে আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারার মতো চরমপন্থা গ্রহণের অবকাশ ইসলামে নেই। ইসলামে কাউকে প্রাণনাশ বা হত্যা করা সামাজিক অনাচার ও অত্যাচারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যারা হালকা ছুঁতায় নিরপরাধ মানুষ হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হয় তারা মানবতাবর্জিত ও সভ্য জগতের শত্রু। পবিত্র কোরআনে নরহত্যাকে চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ঘোষণা দেয়া হয়েছে-

وَلَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَمَنْ قُتِلَ مَظْلُومًا فَقَدْ جَعَلْنَا لِوَلِيِّهِ سُلْطَانًا فَلَا يُسْرِفْ فِي الْقَتْلِ إِنَّهُ كَانَ مَنْصُورًا

অর্থাৎ: ‘আল্লাহ যে প্রাণকে মর্যাদা দান করেছেন, যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তোমরা তাকে হত্যা করো না।’ যাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়, আমি তার অলিকে কিসাস (রক্তপণ) দিয়েছি। সুতরাং সে যেন হত্যাকাণ্ডে সীমালঙ্ঘন না করে। নিশ্চয় সে এর উপযুক্ত যে, তার সাহাত্য করা হবে।’ (সূরা বনি ইসরাইল : আয়াত নম্বর ৩৩)

নিরপরাধ মানুষ হত্যার শাস্তির কথা কোরআনে আল্লাহ বিশদভাবে বর্ণনা করেন এভাবে-

وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ أَنْ يَقْتُلَ مُؤْمِنًا إِلَّا خَطَأً وَمَنْ قَتَلَ مُؤْمِنًا خَطَأً فَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ مُؤْمِنَةٍ وَدِيَةٌ مُسَلَّمَةٌ إِلَى أَهْلِهِ إِلَّا أَنْ يَصَّدَّقُوا فَإِنْ كَانَ مِنْ قَوْمٍ عَدُوٍّ لَكُمْ وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ مُؤْمِنَةٍ وَإِنْ كَانَ مِنْ قَوْمٍ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُمْ مِيثَاقٌ فَدِيَةٌ مُسَلَّمَةٌ إِلَى أَهْلِهِ وَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ مُؤْمِنَةٍ فَمَنْ لَمْ يَجِدْ فَصِيَامُ شَهْرَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ تَوْبَةً مِنَ اللَّهِ وَكَانَ اللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا () وَمَنْ يَقْتُلْ مُؤْمِنًا مُتَعَمِّدًا فَجَزَاؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِدًا فِيهَا وَغَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُ وَأَعَدَّ لَهُ عَذَابًا عَظِيمًا

অর্থাৎ: ‘এটা কোনো মুসলিমের কাজ হতে পারে না যে, সে (ইচ্ছাকৃত) কোনো মুসলিমকে হত্যা করবে। ভুল বশত এরূপ হয়ে গেলে সেটা ভিন্ন কথা। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমকে ভুলবশত হত্যা করবে (তার ওপর ফরজ) একজন মুসলিম গোলামকে আজাদ করা এবং নিহতের ওয়ারিশদেরকে দিয়াত (রক্তপণ) আদায় করা, অবশ্য তারা ক্ষমা করে দিলে ভিন্ন কথা। নিহত ব্যক্তি যদি তোমাদের শত্রু সম্প্রদায়ের লোক হয়, কিন্তু সে নিজে মুসলিম, তবে (কেবল একজন মুসলিম গোলামকে আজাদ করা, ফরজ দিয়াত বা রক্তপণ দিতে হবে না) নিহত ব্যক্তি যদি এমন স্প্রদায়ের লোক হয় (যারা মুসলিম নয় বটে, কিন্তু) যাদের ও তোমাদের মধ্যে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে, তবে (সেক্ষেত্রেরও তার ওয়াশিরদেরকে রক্তপণ দেয়া ও একজন মুসলিম গোলাম আজাদ করা (ফরজ)। অবশ্য কারো কাছে (গোলাম) না থাকলে সে বিরতহীন দু’মাস রোজা রাখবে। এটা আল্লাহর হতে দেয়া তাওবার ব্যবস্থা। আল্লাহ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়।’ 

‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমকে জেনেশুনে হত্যা করবে, তার শাস্তি জাহান্নাম, যাতে সে সর্বদা থাকবে এবং আল্লাহ তার প্রতি গজব নাজিল করবেন ও তাকে লানত করবেন। আর আল্লাহর তার জন্য মাহাশাস্তির প্রস্তুত করে রেখেছেন।’ (সূরা আননিসা : আয়াত নম্বর ৯২-৯৩)
 
কোরআনের অন্যস্থানে আরো বিশদ ও ব্যাপাকারে বর্ণিত-
 
وَكَتَبْنَا عَلَيْهِمْ فِيهَا أَنَّ النَّفْسَ بِالنَّفْسِ وَالْعَيْنَ بِالْعَيْنِ وَالْأَنْفَ بِالْأَنْفِ وَالْأُذُنَ بِالْأُذُنِ وَالسِّنَّ بِالسِّنِّ وَالْجُرُوحَ قِصَاصٌ فَمَنْ تَصَدَّقَ بِهِ فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَهُ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ

অর্থাৎ: ‘এবং আমি তাতে (তাওরাতে) তাদের জন্য বিধান লিখে দিয়েছিলাম যে, প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান ও দাঁতের বদলে দাত। আর জখমেও (অনুরূপ) বদলা নেয়া হবে। অবশ্য যে ব্যক্তি তা (অর্থাৎ বদল) ক্ষমা করে দেবে, তার জন্য তা গুনাহের কাফফারা হয়ে যাবে। যারা আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান অনুসারে বিচার করে না, তারা জালিম।’ (সূরা মায়েদাহ : আয়াত নম্বর ৪৫)

হজরত নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনে কখনো নিরপরাধ কাউকে হত্যা করেননি। গুপ্তহত্যা করেননি। বরং এর ব্যাপারে তিনি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। এক হাদিসে তিনি বলেন- আল্লাহ সবাইকে ক্ষমা করলেও নিরপরাধ মানুষ হত্যাকারীকে আল্লাহ কখনোই ক্ষমা করেন। প্রকৃত কোনো মুসলমান অন্য মুসলমানকে হত্যা করতে পারে না। 

হাদিস শরিফে নিরপরাধ মানুষ হত্যার বিধান বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-

عن أبي وائل عن عبد الله قال : قال رسول الله صلى الله عليه و سلم إن أول ما يحكم بين العباد في الدماء

অর্থাৎ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,  ‘কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম যে মোকদ্দমার ফয়সালা হবে, তাহলো রক্তপাত (হত্যা) সম্পর্কিত।’ (তিরযিযি : হাদিস নম্বর ১৪০৯) 

ধর্মীয় অনুশাসনের ব্যাপক অনুপস্থিতি নিরপরাধ মানুষ খুনের রাস্তাকে উন্মুক্ত করে। খৃষ্টান, ইয়াহুদি, হিন্দু, বৌদ্ধ কোনো ধর্মের মূলমন্ত্রে নিরপরাধ মানুষ হত্যার অনুমতি নেই। যদিও এখন মায়ানমারে বৌদ্ধরা বাচ-বিচারহীন মুসলমানদের মারছে এর দ্বারা তারা তাদের ধর্মীয় বিধানের বিরোধিতা করছে। এমনিভাবে ফিলিস্তিনে ইসরাইলি ইয়াহুদিরা মুসলমানদের মারছে তারাও তাদের ধর্মীয় বিধান লঙ্ঘন করছে। আজ আমাদের দেশে অহরহ নিরপরাধ মানুষ খুন হচ্ছে, কেউ গাড়ি চাপা দিয়ে মারছে, কেউ চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মারছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, একজন মানুষ কর্মস্থলের উদ্দেশে বের হওয়ার পর তিনি জানেন না, কাজ শেষে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছতে পারবেন কী না। বিভিন্ন স্থানে অজ্ঞাতনামা লাশ ও বস্তাবন্দি কঙ্কাল পাওয়ার সংবাদে জনসাধারণের মাঝে একধরনের অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। আজকের এই সমাজকে বাঁচাতে নিজে বাঁচতে ইসলামি শরিয়তের দিকনির্দেশনাগুলো মেনে চলা উচিত এবং অন্যকেও ধর্মীয় জীবনযাপনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। 

ধর্মীয় মূল্যবোধের অনুপস্থিতিই মানুষকে পশুত্বের কাতারে নামিয়ে দেয়। কোরআন হাদিস সমর্থিত হত্যাকাণ্ডের বিধান সমাজে জারি হলে আর কিছু হোক বা না হোক নিরপরাধ হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে।