• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

সর্বশেষ:
ছয়দিনের সফরে ব্যাংককে পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী গরমে ‘অতি উচ্চ ঝুঁকিতে’ বাংলাদেশের শিশুরা: ইউনিসেফ গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা: বেরোবি কেন্দ্রের পরীক্ষার্থী ৩১ হাজার ৯৪৬ জন বাংলাদেশ-ভারত ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে: ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী কাতারের আমিরের সফরে যা পেল বাংলাদেশ

ধর্ষণের ঘটনায় শারীরিক ক্ষত শুকালেও শুকায় না মানসিক ক্ষত

– নীলফামারি বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১৯ জানুয়ারি ২০২০  

ধর্ষণের ঘটনায় শারীরিক ক্ষত শুকালেও শুকায় না মানসিক ক্ষত। পাশাপাশি সামাজিকভাবে দীর্ঘ মেয়াদি বিড়ম্বনার সম্মুখীন হয় ভিকটিম। শুধু তাই নয়, ধর্ষিতার পরিবারকেও বছরের পর বছর পোহাতে হচ্ছে সামাজিক নীপিড়ন। 
কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে ধর্ষিতার মানসিক অবস্থার উন্নতি ঘটলেও সামাজিক নিপীড়ন চলে বছরের পর বছর। আবার নানান কারণে খুব কম সংখ্যক নিপীড়নই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন। এতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ে পাশবিক নির্যাতনের শিকার শিশুরা। 

ধর্ষণের শিকার শিশুর স্বাভাবিক জীবন থমকে যায়। দূরে সরে যায় খেলার সাথীরা। ভর্তি নিতে চায় না স্কুল কর্তৃপক্ষ। অপরিচিত কাউকে দেখলেই দু’চোখে নেমে আসে ভয়। হারিয়ে যায় তাদের চঞ্চলতা। বাবা-মায়ের কাছেও থাকে না কোনো আবদার-অনুযোগ। আদরের সন্তানের এই অস্বাভাবিকতায় মানসিকভাবে মুষড়ে পড়েন অভিভাবকরাও। তার ওপর প্রতিবেশীদের তির্যক কটাক্ষ যেন নির্যাতিতাকেই দাঁড় করায় আসামির কাঠগড়ায়।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) সমন্বয়ক ডা.বিলকিস বেগম দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন ধর্ষণের শিকার নারী-শিশুদের নিয়ে। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, নিয়মিত কাউন্সিলিং করলে ৩ থেকে ৪ মাসের মধ্যে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরে আসতে পারে প্রাপ্তবয়স্ক (১৮ বছরের ঊর্ধ্বে) নির্যাতিতা। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে ৫-৬ বছর লেগে যায়।

তিনি জানান, মহিলা অধিদফতরের আওতাধীন ট্রমা সেন্টারের মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা নির্যাতিত নারী-শিশুর কাউন্সিলিং করেন। এজন্য নিয়মিত তাদেরকে মনোবিদের কাছে আসতে হয়। তবে যত নারী-শিশু এভাবে নির্যাতনের শিকার হন তাদের খুব কম অংশই মনোবিদের শরণাপন্ন হন।

নির্যাতিত শিশুদের বেশ কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ধর্ষণের শিকার শিশুরা সবচেয়ে বেশি মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত (ট্রমাটাইজড) হয়। এজন্য তাদেরকে দীর্ঘ মেয়াদী কাউন্সিলিং করাতে হয়। এসব শিশু ও তাদের অভিভাবকদেরও পড়তে হয় সামাজিকভাবে নানান ধরনের বিড়ম্বনায়।

এসব শিশুর মধ্যে অনেককেই স্থানীয় স্কুলে ভর্তি হতে সমস্যায় পড়তে হয়। অন্য শিশুদের উপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে- শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের এমন আশঙ্কা থেকে স্কুল কর্তৃপক্ষ পাশবিক নির্যাতনের শিকার শিশুকে স্কুলে ভর্তি করাতে চায় না। অনেক ক্ষেত্রে স্কুলে ভর্তি করতে নির্যাতিত শিশুর অভিভাবকদের প্রশাসনের সহায়তা নিতে হয়। নির্যাতনের শিকার শিশুর সঙ্গে সমবয়সী অন্য শিশুর মেলামেশাও সহজভাবে নিতে পারেন না অনেকে। এ ক্ষেত্রে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে শিশুটি।

অথচ মনোবিজ্ঞানীদের মতে, এ ধরনের শিশুদের সার্বক্ষণিক ভালোবাসা আর মমতায় রাখতে হয়। কোনোভাবেই তাকে ওই ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয়া যাবে না। তাকে পড়াশোনা আর খেলাধূলায় ব্যস্ত রাখতে হবে। খুব সহজ-স্বাভাবিক আচরণ করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে ডা. বিলকিস বেগম বলেন, এসব শিশুর সঙ্গে কখনোই এমন কোনো আচরণ করা উচিত হবে না যাতে তার ওই দুঃসহ স্মৃতির কথা মনে পড়ে যায়। তাকে সবসময় আনন্দের মধ্যে রাখতে হবে। ব্যস্ত রাখতে হবে খেলাধূলা আর পড়াশোনায়।

একই কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক ড. নাসরিন ওয়াদুদ। তিনি বলেন, ধর্ষণের ঘটনায় ভিকটিমের মানসিক আঘাত পাওয়ার শঙ্কা থাকে। পরিবার, প্রতিবেশী ও বন্ধুদের সবসময় তাদেরকে সহযোগিতা ও সাহস দিতে হবে। তাদের সঙ্গে এমন কোনো আচরণ করা উচিত হবে না যাতে তাদের সেই ঘটনার কথা মনে পড়ে। এর পাশাপাশি ভিকটিমদের দীর্ঘ মেয়াদি কাউন্সিলিং করা উচিত।

এদিকে ধর্ষণের শিকার প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের বিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রেও বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অভিভাবকরা। এক্ষেত্রে মেয়েটিকে নিজ গ্রাম বা এলাকা ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে হচ্ছে। অনেককে ছেড়ে দিতে হয়েছে পড়াশোনা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এরকম একজন নির্যাতিতার অভিভাবক দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, আমার মেয়েকে নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রাম ছাড়া হতে হলো অথচ ধর্ষক অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে এলাকায়।

ভুক্তভোগী পরিবারকে অনেক সময় আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। পেতে হয় প্রাণনাশের হুমকিও। ২০১৮ সালে ১৯  সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি গ্রামে ধর্ষণের শিকার হন ২০ বছরের এক প্রতিবন্ধী নারী। এ ঘটনায় মামলা হলে গ্রেফতার হয় অভিযুক্ত বাচ্চু। সে এক বছর জেলে থাকার পর জামিনে বেরিয়ে মামলা তুলে নিতে হুমকি দিতে থাকে মেয়েটির পরিবারকে। পরে আদালতে মেয়েটির পরিবারের ৫ সদস্যের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করে। যদিও পরে মামলা দুটির অভিযোগ মিথ্যা বলে তদন্ত প্রতিবেদন দেয় পুলিশ। এদিকে এসব মামলা লড়তে গিয়ে ভুক্তভোগী দরিদ্র পরিবারটিকে এরইমধ্যে খরচ করতে হয়েছে ৩ লাখ টাকারও বেশি।

২০১৬ সালের ১০ অক্টোবর গাইবান্ধার বড় জামালপুরের সাজাল্লাপুরে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয় ৬ বছরের এক শিশু। তার মা বলেন, ‘এখন আর শিশুটি আগের মতো হাসে না, দুষ্টুমিও করে না, প্রতিবেশী শিশুদের সঙ্গে খেলেও না। খেতেও চায় না। কারো কাছে যায়ও না। সারাক্ষণ আমার সঙ্গে লেপ্টে থাকে। ওর এই অবস্থা আমার আর ভালো লাগে না।’

তিনি আরো জানান, ‘আগে টিভি-পত্রিকায় শিশু ধর্ষণের সংবাদ শুনে শিউরে উঠতাম। নিজের ছোট্ট মেয়েকে তাই সবসময় আগলে রাখতাম। এরপরও আমার ভাগ্যেই এমনটা হলো।’ 

এদিকে ঘটনার শিকার শিশুটির পরিবারের উপর নানান অপবাদ দেয়া হচ্ছে। হতাশ কণ্ঠে মেয়েটির মা বলেন, ‘প্রতিবেশীরা এখন উল্টো কথা বলছে। তারা বলছে আমরা নাকি মেয়েকে নিয়ে মিথ্যা কথা বলছি। তিনি বলেন, নিজের মেয়েকে নিয়ে এমন মিথ্যা কি কেউ বলতে পারে?’

চার বছর আগে মানিকগঞ্জে ১১ বছরের এক শিশুকে পাশবিক নির্যাতন করে ৮৫ বছরের বৃদ্ধ হরমুজ মৃধা। শিশুটি এখন কিশোরী। তার বাবা জানান, ওই ঘটনার পর গ্রেফতার হয় হরমুজ মৃধা। তবে ১৫ দিন পরই জামিনে মুক্ত হয়ে এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। তবে নীপিড়নের শিকার মেয়েটিকে স্থানীয় কোনো স্কুলে ভর্তি নেয়নি। বাধ্য হয়ে পরিবার নিয়ে তিনি আশ্রয় নেন রাজধানীতে। বন্ধ হয়ে গেছে তার পড়াশোনা। গ্রামে কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত থাকলেও এখন ঢাকায় রিকশা চালান তিনি। 

রাজধানীর বাড্ডায় ১৭ বছরের প্রতিবন্ধী এক কিশোরীকে ধর্ষণ করে শাওন নামে এক যুবক। ওই কিশোরীর খালা জানান, ৪-৫ বছর আগের ঘটনা হলেও এখনো তার ভাগ্নির মন থেকে সেই ঘটনা মুছে যায়নি। অপরিচিত মানুষ দেখলে সে ভয় পায়। একাও থাকতে পারে না। অভিযুক্ত শাওনকে পুলিশ গ্রেফতার করলেও কিছুদিন পরই তার জামিন হয়ে যায়। এদিকে পাশবিক নির্যাতনের শিকার ওই কিশোরীকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে যশোরে গ্রামের বাড়িতে। সেখানে একটি প্রতিবন্ধী স্কুলে এনজিও’র সহায়তায় পড়াশোনা করছে সে।