• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

নৈতিকতা ও অবক্ষয়ে জর্জরিত সমাজে নাগরিকের দায়িত্ব

নীলফামারি বার্তা

প্রকাশিত: ১ ডিসেম্বর ২০১৮  

নৈতিকতা শব্দটির উৎপত্তি ল্যাটিন Moralitas শব্দ হতে। Moralitas অর্থ হলো ধরন, ভালো আচরণ। নৈতিকতা এক ধরনের মানসিক অবস্থা যা মানুষকে অপরের মঙ্গল চিন্তা করতে এবং সমাজের জন্য ভালো কাজ করার অনুপ্রেরণা দেয়। যেমন-সত্য বলা, গুরুজনকে মান্য করা, অসহায়কে সাহায্য করা, চুরি, দুর্নীতি থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি। এগুলো মানুষের নৈতিকতার প্রমাণ।‘ নৈতিকতার উদ্ভব ঘটে ধর্ম, ঐতিহ্য ও মানব আচরণ’ থেকে।

মূল্যবোধ এক ধরণের ধারণা বা আদর্শ যা মানুষের আচরণের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারকারী । সামাজে বাস করতে হলে মানুষকে কিছু আদর্শ বা মানদণ্ড সাধারণভাবে মেনে চলতে হয়। সমাজে মানুষের যা কিছু করা উচিৎ, আর যা কিছু করা উচিত নয় তার বোধই মূল্যবোধ। সমাজের জন্য যা মঙ্গলজনক তা করাই মূল্যবোধ।

নৈতিকতা বা মূল্যবোধের অবক্ষয়ে জর্জরিত আমাদের বর্তমান সমাজ । এটাই এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা । আমরা সামাজিক জীব। ব্যক্তির যেমন চাহিদা আছে, তেমনি সমাজেরও আছে। মানুষের কাছ থেকে সমাজ সব সময় সামাজিক আচরণ প্রত্যাশা করে। প্রত্যেক সমাজে তার সদস্যদের আচরণ পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতি থাকে। নীতিহীন সমাজে উচ্ছৃঙ্খলতা, বিভ্রান্তি আর ও অনিশ্চিতা বিরাজিত থাকে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ে মানুষের মধ্যে আসছে নানা অনাকাঙিক্ষত পরিবর্তন। সমাজ ও পরিবারে ধরছে ভাঙন। নষ্ট হচ্ছে পবিত্র সম্পর্কগুলো। ছিঁড়ে যাচ্ছে বিশ্বাসের সুতো। চাওয়া-পাওয়ার ব্যবধান বেড়ে যাচ্ছে অনেক । আকাঙক্ষা পরিপূরিত না হওয়ায় প্রতিনিয়ত ঘটছে আত্মহত্যার মতো ঘটনা। অন্যান্য অপরাধপ্রবণতাও বাড়ছে। মা-বাবা, ভাই- বোন, স্বামী-স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সম্পর্কের এমন নির্ভেজাল জায়গাগুলোতেও ফাটল ধরেছে। সৃষ্টি হচ্ছে অবিশ্বাসের। ফলে সম্পর্কের মাঝে জন্ম নিচ্ছে আস্থার সংকট। সেটা যেমন স্বামী স্ত্রীর মধ্যে, তেমনই পিতামাতা-সন্তানদের মধ্যে।

সা¤প্রতিক সময়ে শিশুহত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই, সন্ত্রাস, নকলপ্রবণতা, খাদ্যে ভেজাল, নকল ওষুধ তৈরি বেড়ে গেছে । এ সমাজের এক অতি করুণ রূপ। এখন আর কেউ কারো বন্ধু নয়, আত্মীয় নয়। প্রত্যেকে প্রতিযোগী। সৎ প্রতিযোগী নয়, অসৎ প্রতিযোগী। তাই প্রত্যেকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে একে-অপরের ক্ষতিসাধনে মগ্ন। সামান্য মুঠোফোন চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করেও বয়োঃবৃদ্ধ থেকে শুরু করে শিশু-কিশোরকে পিটিয়ে বা গায়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। গত বছরে অক্টোবরে নরসিংদীতে এমন একটি ঘটনা ঘটেছে। মুঠোফোন চুরির অভিযোগে এক কিশোরী স্কুলছাত্রীকে পরিকল্পিতভাবে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে কেরোসিন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড নিহত কিশোরীর চাচি সঙ্গে ছিল। চাচির দুই ভাই আর দুজন চাচির ভাইয়ের পরিচিত। ।হত্যাকাণ্ডে জড়িত চারজনকে শনাক্ত করতে পেরেছে পুলিশ।

তবে শিশু, কিশোর বা কিশোরীদের নির্যাতনের ঘটনা নতুন নয়। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। কোমলমতি শিশু, কিশোর ও কিশোরীরা শারীরিক-মানসিক এমনকি যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বয়স্ক আত্মীয় স্বজন, চেনা জানা কাছের মানুষ দ্বারা। যাদের কথা কখনই ভাবেনি, তাদের দ্বারাই আক্রান্ত হয়ে শিশুকন্যা, কিশোরীরা হয়ে পড়ছে মানসিক রোগী। কেউ কেউ আত্মাহুতি দিচ্ছে।

মাদকাসক্ত তরুণী ঐশী খুন করল নিজ পিতা-মাতাকে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর রুনি হত্যাকাণ্ড ও পুলিশ কর্মকর্তা বাবুলের স্ত্রী মাহমুদা হত্যাকাণ্ড সমাজকে চরমভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। হত্যা করা হয়েছে দুজন বিদেশেীকেও। তাছাড়া বেশ কয়েকজন ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডগুলির বিচার আজো হয়নি। বিচারহীনতার সংস্কৃতি জন্ম দিচ্ছে নতুন অপরাধের। এসবই সামাজিক অবক্ষয়ের খণ্ড খণ্ড চিত্র। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর চরম আঘাত আসছে প্রতিনিয়ত। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের এই ক্রম অবক্ষয়ে সমাজের সুরক্ষা নিয়ে চিন্তিত দেশের সচেতন বিবেকবান মানুষেরা।

কেন এমন হচ্ছে সেটা ভেবে দেখা দরকার। আগে পরিবারগুলিতে যথাযথভাবে নীতি, আদর্শ শিক্ষা দেয়া হত। পিতা-মাতা নিজেরাও চেষ্টা করতেন সন্তানের কাছে অনুসরণীয় হয়ে ওঠার। বর্তমানে যথার্থ জীবন আদর্শের অভাবে পরিবারগুলো ভোগবিলাস ও পরশ্রীকাতরতায় ভরপূর। সুকুমার বৃত্তির চর্চা এখন আর কী পরিবারে, কী শিক্ষায়তনে আগের মতো হয় না। আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা ও ধনবাদী ধ্যান-ধারণায় গড়ে উঠেছে ভারসাম্যহীন সমাজ। আজকের সমাজ পরিচালিত হচ্ছে স্বার্থান্ধতায়, নৈতিকতায় নয়। বর্তমান বিশ্বে মানুষের সঙ্গে মানুষের অসম প্রতিযোগিতা বাড়ছে। ফলশ্রুতিতে বাড়ছে মানুষে মানুষে দূরত্ব। ব্যক্তিজীবনে কমে আসছে ধৈর্যশীলতা। নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কিংবা রাতারাতি বড়লোক হওয়ার লোভে মানুষ নীতিজ্ঞান আর বিবেক বর্জিত হয়ে যা নয় তাই করছে। এভাবেই দেশ, জাতি, সমাজ, পরিবার ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে ধ্বংসের দিকে।

মানুষের অন্যায্য অনৈতিক ব্যবহারে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে অন্য মানুষ। বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়। দিন দিন মানুষের মানসিক বিকৃতি বাড়ছে। হতাশা বা অস্থিরতা বিরাজ করছে ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সমাজ জীবনে, বেঁচে থাকার প্রতিটি ধাপে। মায়া-মমতা, স্নেহ-ভালোবাসাকে বিসর্জন দিয়ে মানুষ পাশবিক হয়ে উঠছে। এমন কোনো অপরাধ নেই, যা সমাজে সংঘটিত হচ্ছে না। স্ত্রী স্বামীকে, স্বামী স্ত্রীকে, মা-বাবা নিজ সন্তানকে, ভাই ভাইকে অবলীলায় হত্যা করছে। সুষ্ঠু বিচার না পেয়ে বিচারপ্রার্থী ব্যর্থতার যন্ত্রনায় চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। কখনো প্রেম, কখনো অর্থ সম্পত্তির লোভে সমাজে এসব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। অন্যদিকে হতাশা, নিঃসঙ্গতা, অবিশ্বাস আর অপ্রাপ্তিতে সমাজে আত্মহননের ঘটনাও বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে মাদকাসক্তের সংখ্যা। মাদকের অর্থ জোগাড় করতে না পেরে ছেলে খুন করছে বাবা মাকে, স্বামী খুন করছে স্ত্রীকে কিংবা পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে।

সম্পত্তির লোভে মানুষ নিজের সন্তানকে পর্যন্ত হত্যা করছে। সন্তানদের ব্যবহার করছে অন্যায় কাজে। আর যৌতুকের কারণে নির্যাতন ও হত্যা তো নিত্যদিনের ব্যাপার। পারিবারিক বন্ধন, স্নেহ-ভালোবাসা, মায়ামমতা, আত্মার টান সবই যেন আজ স্বার্থ আর লোভের কাছে তুচ্ছ। কেবল তাই নয়, সমাজের উচ্চবিত্ত তরুণ-তরুণীরা বিপথগামী হয়ে পড়েছে। তারা জড়িয়ে পড়ছে খুন, ধর্ষণ ও মাদকাসক্তিসহ নানা অপরাধে।

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খানের মতে, ‘যে সন্তানরা তাদের মা-বাবাকে হত্যার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে কিংবা যে অভিভাবকরা তাদের সন্তান হত্যা করছে, তাদের অনেকেই আর্থিক কারণে এ ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে অভিভাবকরা পরকীয়ার সম্পর্কে জড়িয়ে পারিবারিক কলহ থেকে সন্তানকে হত্যা করছে। এ ক্ষেত্রে অবৈধ সম্পর্ক চালিয়ে নিতে হত্যাকারী কোনো বাধা পেলেই ক্রোধের বশবর্তী হয়ে হত্যার মতো গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। অনৈতিক লোভ, প্রতিযোগিতা, পরচর্চা ও পরকীয়ার কারণেই পারিবারিক এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো ঘটছে।’

মূলকথা, মানুষ দিন দিন প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠছে। নিজেকে জাহির করা, নিজের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষ প্রিয়জনকে হত্যার মতো জঘন্য কাজে লিপ্ত হচ্ছে। নিজের জিদের লাগাম টানতে পারছে না মানুষ। এর প্রধান কারণ মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা। বিচ্ছিন্নতা থেকে তৈরি হয় হতাশা, বিষণ্ণতা। তাছাড়াও মাদকাসক্তি সমাজের এই ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ডগুলোর জন্ম দিচ্ছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘এটি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের এক ধরনের মানসিক বিকৃতির লক্ষণ। সচেতনতা ছাড়া সমাজ থেকে এ ধরনের অপরাধ দূর করা সম্ভব নয়। পাশাপাশি যেকোনো অপরাধ বিশেষ করে শিশু, কিশোর বা কিশোরীদের নির্যাতনের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’

এই অস্থির, নিয়ন্ত্রণহীন, বিরূপ সমাজব্যবস্থার দায় একা সরকারের নয়। কারো একার নয়, বরং সব নাগরিকের। সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায়, সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় এবং সামাজিক অবক্ষয় রোধে প্রতিটি নাগরিককে ভূমিকা রাখতে হবে, দায়িত্বশীল হতে হবে। প্রথমে নিজেদের করতে হবে নৈতিক ও আদর্শ জীবনযাপন। পালন করতে হবে শিষ্টাচার। শুরু করতে হবে পরিবার থেকে। গড়ে তুলতে হবে যথার্থ দেশপ্রেমিক নাগরিক। তারাই প্রচেষ্টা চালাবে রাষ্ট্রকে জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে, সমাজে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে, সমাজের সংকটময় মুহূর্তে জনগণের পাশে দাঁড়াতে। এভাবেই আস্তে আস্তে এ সমাজ নৈতিক ও মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজে পরিণত হবে।

-আফরোজা পারভীন