বঙ্গমাতা ত্যাগের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে গেছেন- প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ত্যাগের মধ্য দিয়ে একটা সংসারকে সুন্দর করা যায়, একটা প্রতিষ্ঠানকে সুন্দর করা যায়, একটা দেশকে সুন্দর করা যায়। চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার চেয়ে বড় আর কিছু হয় না। আমার মা বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিব সেই দৃষ্টান্তই দেখিয়ে গেছেন।

শনিবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের ৯০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। 

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে গোপালগঞ্জ প্রান্তে সংযুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে এক হাজার ৩০০ সেলাই মেশিন, ১০০টি ল্যাপটপ ও ১৩ হাজার উপকারভোগীর মাঝে নগদ অর্থ বিতরণ করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিটি কাজে আমার মাকে দেখেছি বাবার পাশে থেকে সহযোগিতা করেছেন। কখনও সংসারের কোনো সমস্যা নিয়ে বিরক্ত করেননি বা বলেনওনি। বরং বেশিরভাগ সময়ই তো আমার বাবা কারাগারে ছিলেন। একটানা দুই বছরও তিনি কারাগারের বাইরে থাকেননি। কিন্তু আমার মা যখন কারাগারে দেখা করতে যেতেন, তখন মা নিজেই বলতেন, চিন্তার কিছু নেই। সব কিছু তিনি নিজেই দেখতেন। আমাদের মানুষ করার দায়িত্ব আমার মায়ের হাতেই ছিল। তার পাশাপাশি বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ প্রতিটি সংগঠনের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। নির্দেশনা দেয়া বা বাইরের অবস্থা জেলখানায় থাকা আব্বাকে জানানো, বাবার নির্দেশনা নিয়ে এসে সেগুলো পৌঁছে দেয়া। এই কাজগুলো তিনি খুব দক্ষতার সঙ্গে করতেন।

তিনি আরো বলেন, যেসব নেতারা কারাগারে বন্দি থাকতেন, কার বাড়িতে কী অবস্থা, তাদের বাড়িতে বাজার আছে কিনা, সেখানে সাহায্য করা লাগবে কিনা, কোনো আওয়ামী লীগের কর্মী অসুস্থ হলে তাকে চিকিৎসা করা ও দেখতে যাওয়া সবই বাবার অবর্তমানে মা করতেন। একদিকে সংসার সামলাতেন, অপরদিকে এই কাজগুলোও করতেন। পাশাপাশি সংগঠনকে তিনি দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতেন। সঠিক সিদ্ধান্তগুলো দিতেন।

নিজের মা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমার বাবা যখন প্রধানমন্ত্রী হয়ে ফিরে এলেন, তখনও কিন্তু আমার মায়ের মধ্যে অহমিকা বোধ ছিল না। তিনি কখনও সরকারি বাসভবনে বসবাস করেননি। কাজের জন্য আমার বাবা সকালে বাড়ি থেকে নাস্তা করে চলে আসতেন। আবার দুপুরে আমার মা নিজের হাতে রান্না করে টিফিন ক্যারিয়ারে পাঠিয়ে দিতেন। রান্নাটা সব সময় নিজের হাতে করতেন। তিনি যে প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী, পাকের ঘরে গিয়ে রান্না করবেন, সেই সমস্ত চিন্তা তার কখনও ছিল না। আমার মায়ের হাতের রান্না খুবই সুস্বাদু ছিল। গণভবনে বা সরকারি বাসভবনে থাকেননি। না থাকার কারণটা হচ্ছে, তিনি বলতেন, আমার ছেলে মেয়েকে নিয়ে সরকারি বাসভবন বা শানশওকতে থাকবো না। তারা বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত হোক সেটা আমি চাই না। বিলাসিতায় আমরা যেন গা না ভাসাই, সেটার ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তিনি সব সময় আমাদের সেই শিক্ষাই দিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বাবা-মায়ের কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছি মাটির দিকে তাকিয়ে চলার। অন্তত তোমার চেয়ে খারাপ অবস্থায় কে আছে তাকে দেখো। ওপরের দিকে না, তোমার চেয়ে কে ভালো আছে সেটা না, তোমার চেয়ে খারাপ যারা আছে তাদের দিকে দেখো এবং সেটাই উপলব্ধি করো। কখনও নিজের দৈন্যতার কথা বলতেন না। কখনও কোনও চাহিদা ছিল না। নিজে কোনোদিন কিছু চাননি। সব সময় তিনি দিয়ে গেছেন। ১৯৫৮ সালে মার্শাল ল’ জারি হওয়ার পর আব্বা ইন্স্যুরেন্সে চাকরি করতেন। এই দুবছর আমার মা সংসারের স্বাদ পেয়েছিলেন। কারণ তখন রাজনীতি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। স্বামীকে কাছে না পাওয়া নিয়েও তার কোনও অনুযোগ ছিল না। এমনকি মৃত্যুর দিন আমার মা জীবন ভিক্ষাও চাননি। তিনি নিজে বাঁচতে চাননি। তিনি সাহসের সঙ্গে সেখানে এ কথাই বলেছিলেন, আমার স্বামীকে হত্যা করেছো, আমি তার কাছেই যাবো। সেখানেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। আমার মা আমার বাবার একজন উপযুক্ত সাথী হিসেবেই চলে গেছেন।

সরকারপ্রধান বলেন, আজকে তার (বেগম মুজিব) জন্মদিন। সেই জন্মের পর ৩ বছর থেকেই পিতা-মাতা সব হারিয়ে সারাটা জীবন শুধু সংগ্রামই করে গেছেন। কষ্টই করে গেছেন। কিন্তু এই দেশের স্বাধীনতা, এই স্বাধীনতার জন্য তিনি যে কত দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন সেটা আমরা জানি। এই দেশ স্বাধীন হবে, বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি আসবে, বাংলাদেশের মানুষ ভালো থাকবে, এই চাওয়াতেই তিনি নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। আব্বার যে আদর্শ, সেই আদর্শটা তিনি খুব সঠিকভাবে ধারণ করেছিলেন। আর সেটা ধারণ করেই তিনি নিজের জীবনটাকে উৎসর্গ করে দিয়ে গেছেন। কোনও দিন সংসারের কোনো ব্যাপারে মা-বাবাকে কখনোই কিছু বলেননি, কোনো কিছু চাননি। ফলে আমার বাবা সম্পূর্ণভাবে দেশের জন্য কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। আমি মনে করি আমাদের দেশের মেয়েদেরও সেই আর্দশ নিয়েই চলা উচিত।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাসের এই সংকট থেকে দেশকে আমরা অবশ্যই উত্তরণ ঘটাবো। বাংলাদেশকে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবো। সেখানে আমার মায়ের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না, লাখো শহীদের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী রওশন আক্তার। এসময় বঙ্গমাতার কর্মময় জীবনের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র পরিবেশন করা হয়। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বেগম মতিয়া চৌধুরী। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি মেহের আফরোজ চুমকি।