• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

সর্বশেষ:
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অন্যতম নকশাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাস, আজ ৭৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। বন্যায় দুবাই এবং ওমানে বাংলাদেশীসহ ২১ জনের মৃত্যু। আন্তর্জাতিক বাজারে আবারও বাড়ল জ্বালানি তেল ও স্বর্ণের দাম। ইসরায়েলের হামলার পর প্রধান দুটি বিমানবন্দরে ফ্লাইট চলাচল শুরু। ইসরায়েল পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইরানে।

বাংলাদেশ প্রধান চার খাদ্যে এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ

– নীলফামারি বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৯  

চাল ও মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা বাংলাদেশকে প্রকৃত ভাতে-মাছে বাঙালি করে তুলেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মাংস ও সবজি উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। ক্রমবর্ধমান চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সরকারের অনুকূল নীতিমালা অনুসরণ করে গত দশ বছরে চাল, মাছ, মাংস ও শাকসবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ অর্জন করেছে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মাছ উৎপাদনকারী দেশ। দেশি চাহিদা পূরণ করে এসব পণ্য বিদেশে রফতানিরও প্রস্তুতি নিচ্ছে কিছু প্রতিষ্ঠান। 

পোল্ট্রি শিল্প:
পোল্ট্রি শিল্পে গত দশ বছরে বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২০০ শতাংশ। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর এবং বাংলাদেশ পোল্ট্রি শিল্প কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী ২০১০ সালে হাঁস-মুরগির শিল্পে উৎপাদন আয় ছিল দশ হাজার কোটি টাকা। যা বর্তমানে বৃদ্ধি পেয়ে ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার কোটিতে পৌঁছেছে। 

বাংলাদেশ পোল্ট্রি শিল্প কেন্দ্রীয় কাউন্সিল জানিয়েছে, দেশের প্রায় ১ দশমিক ৬৫ লাখ মানুষ ডিম ও মাংস উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর দাবি করেছে দেশে এখন মোট ৮১ হাজার ৬১৪টি পোল্ট্রি ফার্ম রয়েছে।  

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, একজন ব্যক্তির শরীরে দৈনিক ১২০ গ্রাম মাংসের চাহিদা থাকে। ২০১৭ সালেই সে চাহিদা পূরণ করেছে বাংলাদেশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৭৫ লাখ টন সাদা ও লাল মাংস উৎপাদন করেছে। যা ২০০৯-১০ অর্থবছরে ছিল ১২ দশমিক ৬০ লাখ টন। সে হিসাবে বিগত ১০ বছরের তুলনায় প্রায় ছয়গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এ উৎপাদন বৃদ্ধি গরুর মাংসের দাম কমাতে পারেনি। ১০ বছরে গরুর মাংসের দাম প্রতি কেজিতে দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৫৫০ টাকায় পৌঁছেছে। 

প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক ডা. এ বি এম খালেদুজ্জামান জানান, কৃষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ, ঋণ সুবিধা ও ভূর্তুকি এ খাতকে দ্রুত বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। ফলে উৎপাদনকারীরা এখন স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে রফতানির প্রস্তুতি নিচ্ছে।


 

মাংস উৎপাদকরা বলেছেন, ১৯৯০ সাল থেকে পোল্ট্রি খাতটি বেসরকারি বিনিয়োগ পাওয়া শুরু করে। ১৯৯৬ সালে পোল্ট্রি খাতে সরকারের কর মওকুফের মাধ্যমে এ শিল্প ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগের প্রতি আরো আকৃষ্ট হয়। এছাড়া ২০০০ সালের পর থেকে বড় বড় বিনিয়োগকারীরা আধুনিক প্রযুক্তিসহ উদীয়মান পোল্ট্রি ব্যবসায় প্রবেশ করছে। 

২০০৭ সালে অ্যাভিয়ান পাখির ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত রোগ অ্যাভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা (বার্ড ফ্লু) এ খাতে বিশাল আঘাত হানে। ফলে অনেক খামারি লোকসানের শিকার হয়। ২০০৯ সাল পর্যন্ত এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি তারা। পোল্ট্রি খাতটি ২০১৩ সালে অ্যাভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার ভ্যাকসিন আমদানির অনুমতি নেয়। এরইমধ্যে ২০০৮ সালে সরকার জাতীয় পোল্ট্রি উন্নয়ন নীতি জারি করে যেখানে পোল্ট্রির আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র আমদানিকে করের আওতা থেকে দূরে রাখে। 

দুধ ও ডিমের উৎপাদন বৃদ্ধি: 
গত এক দশকে দেশে দুধ ও ডিমের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাৎসরিক হিসাব অনুযায়ী প্রত্যেক মানুষের জন্য ১০৪টি ডিমের প্রয়োজন তবে বর্তমানে এর বার্ষিক সরবরাহ ১০৩টি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ডিমের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭১১ কোটি। 

খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী প্রতিটি মানুষের শরীরে দৈনিক ২৫০ গ্রাম দুধের প্রয়োজন। এ হিসাব অনুযায়ী বাৎসরিক মোট ১৫২ লাখ টন দুধের উৎপাদন প্রয়োজন। গত অর্থবছরের মোট উৎপাদন ছিল ৯৯ লাখ টন। ২০০৯-১০ অর্থবছরে দুধের উৎপাদন ছিল ২৩ লাখ টন।  

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটা ছাড়াও বেসরকারি বিনিয়োগ দুগ্ধ খাতকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তবে দুধ আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা এখনো রয়ে গেছে। বিগত ১০ বছরে দুধের উৎপাদন তিনগুণ বেড়েছে। উৎপাদন ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে মিল্ক ভিটা। ২০০৫ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে আড়ং, প্রাণ, আকিজ, আফতাব গ্রুপের মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও এ খাতে উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে। ২০০৭ সালে সরকার জাতীয় প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন নীতি চালু করে। তবে জাতীয় দুগ্ধ উন্নয়ন নীতিমালার খসড়া ২০১৬ সালে চূড়ান্ত হয়। বর্তমানে পুরো দেশ জুড়ে প্রায় ৬৮ হাজার এর বেশি নিবন্ধিত দুগ্ধ খামার আছে। 


 

বিশ্ব ব্যাংকের চার হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটি প্রাণিসম্পদ ও দুগ্ধ উন্নয়ন প্রকল্পে মাংস ও দুগ্ধের উৎপাদন বাড়িয়ে দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. আব্দুল জব্বার শিকদার বলেন, বর্তমানে দেশ ডিম ও দুধ উৎপাদনে পিছিয়ে থাকলেও দুগ্ধ খাত দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুধের চাহিদা মেটাতে বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলেও আশা করন তিনি। 

বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ডা. নাথু রাম সরকার বলেন, খাদ্য উৎপাদনে দেশ স্বনির্ভরতা অর্জন করায় পুষ্টির ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে গবেষণা ইনস্টিটিউট। তিনি বলেন, মাংসের তুলনায় দুধ ও ডিমের উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই প্রক্রিয়াটিকে আরো বেগবান করতেেআমরা কাজ করছি।

অভ্যন্তরীণ মৎস্য চাষে তৃতীয় বাংলাদেশ:
একটা সময় ছিল যখন খোলা পানির (খাল, বিল) মাছ স্থানীয় বাজারে প্রাধান্য বিস্তার করতো। তবে বর্তমানে দেশীয় বাজারের ৫৬ শতাংশ দখল করে আছে চাষ করা মাছ। মৎস্য অধিদফতর জানিয়েছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট ৪৩ লাখ টন মাছ উৎপাদন করা হয়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে যার পরিমাণ ছিল ২৯ লাখ টন। 

খাদ্য ও কৃষি সংস্থার একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ খোলা মৎস্য চাষে তৃতীয় ও অভ্যন্তরীণ চাষ করা মৎস্য সংস্কৃতিতে পঞ্চম। দৈনিক একজন মানুষের শরীরে ৬০ গ্রাম মাছের চাহিদা থাকে। তবে সরবরাহ হয় ৬২ দশমিক ৫৮ গ্রাম। যা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি। 

মৎস্য অধিদফতরের উপপরিচালক ডা. মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান বলেন, এক সময় কেজি প্রতি পাবদা মাছের দাম ছিল ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা। যার বর্তমান দাম ৪০০-৫০০ টাকা। মাছের বৃহৎ পরিমাণ চাষের কারণেই এ পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে বলেও জানান তিনি। 
 
দেশ জুড়ে এক হাজারেরও বেশি বেসরকারি হ্যাচারি মাছ উৎপাদন ও সরবরাহের কাজ করছে। মাছের সংস্কৃতিতে কার্প মাছ একসময় যদিও অনেক প্রাধান্য পেয়েছিল তবে স্থানীয় প্রজাতির মাছ বেশি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে এখন। গত দুই বছরে সামগ্রিক মৎস্য উৎপাদনে মূল ভূমিকা পালন করছে ইলিশ মাছ। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে দেশে ৪ দশমিক ৯৮ লাখ টন ইলিশের উৎপাদন হয়েছে। পরবর্তী অর্থবছরে এর পরিমাণ বেড়ে ৫ দশমিক ১৭ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে। 

চাল উৎপাদন বৃদ্ধি:
বাংলাদেশ চাল ও শাকসবজি উৎপাদনে কয়েক বছর আগেই স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ৩ দশমিক ৮৬ কোটি টন চাল উৎপাদন হয়েছে। আউশ ও আমন ধানের ব্যাপক ফলনের ফলে এ উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। যা ২০১১-১২ অর্থবছরে চালের উৎপাদন ছিল ৩ দশমিক ৩৮ কোটি টন। দেশে চালের বার্ষিক চাহিদা ৩ দশমিক ৫ কোটি টন। 

২০১৭ সালের দুইবারের বন্যায় ধানের বাজারকে অস্থির করে তোলে। দেশীয় বাজার স্থিতিশীল করতে সরকার ৬০ লাখ টন চাল আমদানি করতে ২৮ শতাংশ কর মওকুফ করেছিল। বর্তমানে কিছু বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশের চাল রফতানির সঙ্গে যুক্ত আছে। 

কৃষিমন্ত্রী ডা. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, বিগত দশ বছরে খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। চাল, শাকসবজি ও শস্য উৎপাদনে আমরা এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। বর্তমানে এর কিছু রফতানিও করা হচ্ছে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে খাদ্য রফতানি করতে সক্ষম হওয়া দেশের জন্য একটি বিশাল অর্জন। পেঁয়াজ উৎপাদনে এখনো ঘাটতি রয়েছে। তবে আমরা সেখানেও স্বনির্ভরতা অর্জন করবো।