• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

সর্বশেষ:
বাংলাদেশকে হুমকির মুখে ফেলেছে ক্রমবর্ধমান জলরাশি: গবেষণা উত্তরবঙ্গের মহাসড়কে চার লেন চালু, ঈদযাত্রা হবে স্বস্তির সব উন্নয়ন সহযোগীদের এক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী বিডিএস ভূমি ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে: ভূমিমন্ত্রী বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা দিতে হবে: ওবায়দুল কাদের

মসজিদে নববীর আদর্শ ও আমাদের মসজিদ

নীলফামারি বার্তা

প্রকাশিত: ২৬ নভেম্বর ২০১৮  

আধুনিক মুসলিম সমাজের মসজিদ সম্পর্কে ধারণা কেমন? মসজিদে কোন কোন কাজ করা যাবে বা করা উচিত বলে আমরা মনে করি?

সহজ উত্তর, মসজিদ হলো নিভৃতস্থান; ব্যক্তিগত ইবাদত আর জিকির-আজকার ছাড়া কোনো কিছু সেখানে হতে পারে না। সামাজিক বা সরকারি কোনো কাজ মসজিদে করা নিষেধ। এ জন্যে দেখা যায়, মসজিদ কেন্দ্রিক কোনো সামাজিক বা সাধারণ শিক্ষামূলক কার্যক্রম আমাদের সমাজে সচরাচর পরিচালিত হয় না। কিন্তু মসজিদ কি শুধু এ কাজগুলোর জন্য?

কালিম সিদ্দীকি হাফিজাহুল্লাহ। প্রসিদ্ধ একজন ইসলামী ব্যক্তি। মসজিদে নববীর আদলে আমাদের মসজিদগুলো কতটুকু পরিচালিত হচ্ছে এক আলোচনায় তিনি তা তুলে ধরছেন। একজন ইমামের দায়িত্ব, একটি আদর্শ মসজিদের কার্যক্রমও ফুটে উঠেছে তার আলোচনায়। পাঠকদের ফায়দার চিন্তায় নিম্নে তা তুলে ধরা হলো।

তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) এর মসজিদ, মসজিদে নববী। তিনি হলেন আমাদের সকলের আদর্শ। এতে কোনো সন্দেহ নেই, তিনি যেমন আমাদের আদর্শ তেমনিভাবে তাঁর মসজিদও হবে অন্য সকল মসজিদের আদর্শ। অনেক হাদীসে মসজিদে নববীর কার্যক্রম পাওয়া যায়। এগুলো পর্যালোচনা করলে বুঝা যায়, মসজিদে নববী শুধু ব্যক্তিগত ইবাদত ও জিকির-আজকারের স্থান ছিলো না।

মদীনা রাষ্ট্রের প্রাণকেন্দ্র ছিলো মসজিদে নববী। সামাজিক কাজ, মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষার মারর্কাজ ছিলো মসজিদে নববী। মদীনা রাষ্ট্রের সকল কার্যক্রম পরিচালিত হতো মসজিদে নববী থেকে। রাসূল (সা.) এর পক্ষ থেকে নির্দেশ ছিলো, ‘তোমরা নিজেদের ঘরকে কবর বানিয়ে রেখো না।’ অর্থাৎ ফরজ মসজিদে আদায় করে, নফল, সুন্নত ঘরে এসে আদায় কর। এর একটি কারণ এও হতে পারে, মসজিদে লম্বা সময় নফল পড়া হলে, মসজিদের অন্যান্য কাজ বন্ধ থাকবে। তাই অন্যান্য কাজের জন্য মসজিদ খালি করার তাকিদ থেকে তিনি এ নির্দেশ দিয়েছেন।

মসজিদে হারামের পর দুনিয়ার সর্বোত্তম মসজিদ, মসজিদে নববী। মহানবী (সা.) ছিলেন সেই মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণকারী। তিনি বেইমান ইহুদী, নাসারা ও মুশরিকদের মসজিদে থাকার অনুমতি দিতেন। তারা মসজিদে নববীর পরিবেশ ও নবী করিম (সা.) এর আচার ব্যবহার দেখে মুগ্ধ হয়ে ইমান নিয়ে আসতো।

একবারের ঘটনা। এক ইহুদী মেহমানকে তিনি মসজিদে থাকার ব্যবস্থা করলেন। প্রশ্রাবের প্রয়োজন দেখা দিলে, সে বেচারা মসজিদে নববীর বারান্দায় বসে গেলো। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) তার দিকে দৌড়ে আসতে লাগলেন। রাসূল (সা.) তাদের বারণ করে বললেন, এমতাবস্থায় তাকে একাজ থেকে ফিরালে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। মেহমান প্রয়োজন সারার পর, নির্দেশ দিয়ে বললেন, যাও, পানি ঢেলে পরিস্কার করে আসো। আর মেহমানকে অত্যন্ত ইজ্জতের সঙ্গে বললেন, এটা দুনিয়ার সবচেয়ে সম্মানিত জায়গা মসজিদ। মসজিদ আল্লাহর ঘর। এখানে প্রশ্রাব-পায়খানা করা যায় না। এই বর্ণনা এসেছে দুনিয়ার সর্বোত্তম মসজিদ ও মহানবী মুহাম্মাদ (সা.) সম্পর্কে।

আজ আমাদের অবস্থান কোথায়? কোনো বেইমান তো দূরের কথা, একজন বেনামাজি নতুন যখন মসজিদে আসে তখন আমরা মুখ ব্যঙাতে থাকি। যাওয়ার পর নামাজিদের মাঝে তাকে নিয়ে কানাঘুষা শুরু হয়ে যায়। আর কেউ কেউ তো বলেই ফেলি, মসজিদ নাপাক করে দিয়ে গেছে-আল্লাহ এ সকল কথা থেকে সকলকে হেফাজত করুন।

মসজিদে নববীর আরেকটা ঘটনা। এ থেকে অনেক কিছু আমাদের শিখার আছে। রাসূল (সা.) মসজিদে খুতবা দিচ্ছিলেন। দেখলেন, হজরত হাসান ও হুসাইন (রা.) তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। তিনি মিম্বার থেকে নেমে এসে তাদের দুজনকে কাঁধের ওপর উঠালেন। আদরের সঙ্গে চুমু খেয়ে বললেন, ‘আমার এই দুই সন্তান সায়্যেদ।’ একজন সাধারণ লোক এই দৃশ্য দেখে আশ্চর্য হয়ে বলতে লাগলেন, এত লোকের সামনে আপনি তাদেরকে চুমু দিচ্ছেন? রাসূল (সা.) বিরক্তির সুরে বললেন, ‘তোমার অন্তর থেকে আল্লাহ রহম দয়া উঠিয়ে নিলে আমার করার কি করার আছে?’

আরেকটা ঘটনা। রাসূল (সা.) একবার নামাজ পড়াচ্ছিলেন। সেজদায় গেলে, হজরত হাসান বা হুসাইন তাঁর পিঠে সওয়ার হলো। ছোট বাচ্চা পড়ে গেলে ব্যথা পাবে, তাই তিনি সেজদা লম্বা করলেন। আরো একটি ঘটনা। ইসলামের শুরু যুগে মহিলারাও জামাতে নামাজ পড়তে পড়তো। একবার নবী করিম (সা.) নামাজ পড়াচ্ছিলেন। নামাজে তিনি বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলেন। মায়ের মনে বাচ্চার আওয়াজ উদ্বেগ সৃষ্টি করবে। মা কষ্ট পাবে। তাই তিনি নামাজ দ্রুত শেষ করে মাকে যাওয়ার সুযোগ করে দিলেন।

আমাদের মসজিদগুলোর অবস্থা কেমন? ছোট ছোট বাচ্চারা বাপ-দাদাকে দেখে নামাজে আসে। তাদের দেখে বাচ্চারা নামাজ শিখে। কিন্তু মসজিদে এসে আওয়াজ করলেই আমরা শাসানো শুরু করি। কখনো কখনো তো এই পরিমাণ শাসানো হয়, কান ধরে ঐ বাচ্চা তওবা করে যে, আর কখনো মসজিদে আসা যাবে না। কারণ, মসজিদ অনেক কঠিন জায়গা। এখানে কিছু করলে অনেক বকা-ঝকা শুনতে হয়। দেখা যায়, বাচ্চার আওয়াজ দ্বারা নামাজিদের যতটুকু কষ্ট হয়েছে, তার কয়েকগুণ বেশি মুসল্লিদের কষ্ট হয় শাসানোর আওয়াজ দ্বারা। মসজিদে নববীতে অমুসলিমদের থাকার সুযোগ দেয়া হতো। তাদের কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এ বিষয়গুলো বহু হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু আমাদের মসজিদগুলোর দিকে তাকালে দেখতে পাই ভিন্ন অবস্থা। অমুসলিম তো দূরের কথা, শাখাগত মতপার্থক্যের কারণেও ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। মসজিদে আসতে দেয়া হয় না। আল্লাহ তায়ালা আমাদের বুঝার তাওফীদ দান করুন-আমীন।

মসজিদে নববীতে একই সময় কিছু মানুষ জিকির করতেন। আর কিছু মানুষ নফল নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত করতেন। কেউ কেউ তখন দ্বীনী ইলেম শিখতেন। সঙ্গে সঙ্গে চলতো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মুজাকার। কিন্তু কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায় না যে, এক গ্রুপে অন্যদের সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়েছেন। কিন্তু আমাদের অবস্থা এত নাজুক যে, দুই জামাত এক মসজিদে বসলে মনে হয় যুদ্ধাবস্থা জারি হয়ে গেছে। অথচ উভয় দল হক।

মুসলমান সমাজের প্রত্যেকটি মসজিদের মেহরাব, মিম্বার মসজিদে নববীর স্থলাভিষিক্ত। প্রত্যেকজন ইমাম, আল্লাহর নবীর প্রতিনিধি হিসেবে মসজিদে ইমামতি করেন। সে হিসেবে মুসলমানদের সমাজে একজন ইমামের মর্যাদা কতটুকু থাকার দরকার ছিলো? নবীর প্রতিনিধি যে ইমাম, তাকে আমরা বেতনভূক্ত কর্মচারী মনে করি। কোথাও তো কাজের লোকের ন্যায় আচরন করা হয়। তাহলে আমাদের সমাজে একজন ইমামের মর্যাদা কতটুকু রইলো?

মুসলমান হিসেবে আমাদের জন্য দুঃখজনক বিষয় যে, ইমামের মতো এমন একজন সম্মানিত ব্যক্তির মর্যাদা সম্পর্কে আমরা অবগত না। মসজিদ ঝাড়– দেয়া ছওয়াবের কাজ। সমাজের সকলের ছওয়াবের প্রয়োজন আছে। মসজিদের অন্যান্য কাজও এ রকমই। কোনো ইমাম যদি ছওয়াবের আশায় এ কাজ করেন তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু ইমামতির সঙ্গে সঙ্গে টয়লেটের কাজ ইমামের ওপর ন্যস্ত করা, ইমামতের মাকামের পরিপন্থি। অথচ আমরা এই কাজটাই করে যাচ্ছি।

মুসলমানদের সোনালী যুগে পুরো সমাজ ব্যবস্থা ছিলো মসজিদ কেন্দ্রিক। মুসলমানের তালীম, তরবিয়ত ও শিক্ষা-দীক্ষার কেন্দ্র ছিলো মসজিদ। দ্বীনী কাজ, সাধারণ কাজ সবকিছুর জন্য মসজিদে আসতে হতো। তাই সকল কাজকে দ্বীনী কাজ বানিয়ে সকলে মসজিদে আসতো। শরীয়তের হুকুম হলো, নাপাক অবস্থায় মসজিদে আসা যায় না। অন্যদিকে সকল কাজের জন্য মসজিদে যাওয়া আসা করা লাগে। এজন্য সর্বদা পবিত্র থাকার অভ্যাস সকলের গড়ে উঠতো।

ঐ সমাজ ইসলামী আদর্শ সমাজ বনতে পারবে না, যে সমাজের কার্যক্রমের মূলকেন্দ্র মসজিদ হবে না। এজন্য নববী যুগে মসজিদে নববী কিভাবে চলতো তা আমাদের জানতে হবে। এবং আমাদের মসজিদেও তা চালু করতে হবে। আমাদের মসজিদগুলোকে মসজিদে নববীর ধারায় গড়ে তুলতে হলে নিম্মেক্ত কাজগুলো করতে হবে-

(১) মসজিদকে সমাজের প্রাণকেন্দ্রের মর্যাদা দিতে হবে। ইমামকে মনে করতে হবে আমার সকল বিষয়ের মন্ত্রনাদাতা। মসজিদকে শুধু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জায়গা না বানিয়ে, মানবতার ব্যাপক কল্যাণের মার্কাজ বানাতে হবে। জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সকল অভাবীদের মসজিদ কেন্দ্রিক সাহায্যের ব্যবস্থা চালু করতে হবে। তবে তা বর্তমানের প্রচলিত সিস্টেম অনুযায়ী নয়। এর দ্বারা, সমাজের একে অন্যের প্রতি দায়বদ্ধতার পরিবেশ তৈরি হবে। যা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

(২) ইমাম সাহেবের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। নিজকে শুধু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের ইমাম ভাবলেই চলবে না। নবী (সা.) যেমন সকলের প্রতি দায়িত্বের চেতনা রাখতেন, তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে আমাকেও তা ধারণ করতে হবে। তিনি যেমন সকল ধর্মের লোকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করেছিলেন আমাকেও তা করতে হবে। দ্বিনী বিষয় ছাড়াও মহল্লার বাচ্চাদের শিক্ষা-দীক্ষা, সামাজিক ও সাধারণ বিষয় যেমন চিকিৎসা ও অর্থনীতি বিষয়েও ইমাম সাহেবকে ভাবতে হবে।

(৩) সকল ধর্ম, বর্ণ ও মতের লোকদের জন্য মসজিদ উন্মুক্ত করে দিতে হবে। যে কেউ যেন সমস্যা নিয়ে মসজিদে আসতে পারে।

(৪) বিধর্মীদেরকে মাঝে মাঝে মসজিদে দাওয়াতের ব্যবস্থা করতে হবে। মসজিদের সকল কার্যক্রম দেখার সুযোগ করে দিতে হবে। দুনিয়ার বুকে মুসলিম এমন আছে, যারা জামাতে নামাজের সৌন্দর্য দেখে মুসলমান হয়েছে।

(৫) মসজিদের বাহ্যিক সৌন্দর্যে বেশি অর্থ খরচ না করে, শিক্ষামূলক কার্যক্রমকে গতিশীল করতে হবে। মসজিদে যারা আসেন, তাদের প্রত্যেকের ইলেমের পিপাসা নিবারণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। সে জন্যে মসজিদে সমৃদ্ধ পাঠাগার গড়ে তুলতে হবে।

(৬) সাধারণ মানুষকে সেবা দেয়ার লক্ষ্যে, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল ও অন্যান্য অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সময় করে মসজিদে বসার ব্যবস্থা রাখতে হবে।

(৭) মসজিদে নববীর আদলে আমাদের মসজিদগুলো পরিচালিত হওয়ার জন্য, মসজিদে নববীর কার্যক্রম সম্পর্কে মুসল্লিদের অবগত হতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন এ সংক্রান্ত আলোচনা বারবার করা।

 

অশান্ত এ পৃথিবীতে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে, মুসলমানদের পরস্পর সুসম্পর্ক তৈরি করতে হবে। এর জন্য মসজিদ ভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলার বিকল্প নেই। মসজিদ ভিত্তিক উল্লেখিত কর্মসূচিগুলো যে সমাজে সুন্দরভাবে বাস্তবায়ন হবে, আশা করি সে সমাজের চেহারা হবে অন্য রকম।

মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে মসজিদ ভিত্তিক জীবন ব্যবস্থা গড়ে তোলার তাওফীক দান করুন। আল্লাহুম্মা আমীন।