• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

মাদক প্রতিরোধে ইসলাম

– নীলফামারি বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯  

আরবি ‘খমর’ শব্দের অর্থ হচ্ছে মস্তিষ্কের সুশৃঙ্খল কর্মকাণ্ড ভেঙ্গে দিয়ে মত্ততা সৃষ্টি করার উপাদান। যার নাম অ্যালকোহল বা মাদকদ্রব্য। এমনকী নেশা সৃষ্টি করে এমন দ্রব্য সামগ্রীও ‘খমর’ এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন হেরোইন, কোকেন, কোবেক্স, ইয়াবা ইত্যাদি।

মাদক; শয়তানী কর্ম। নাপাক ও ঘৃণিত দ্রব্য। খাদ্য ও পানীয়ের একটি বিশেষ  প্রকার হলো মাদকাযুক্ত খাদ্য বা পানীয়। আমরা মানব সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই যে, মানবীয় অপরাধ, পারিবারিক ও সামাজিক অবক্ষয় ও বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হলো মাদকতা। মদ্যপান ও মাদকাসক্তি শুধু আক্রান্ত ব্যক্তিরই ক্ষতি করে না উপরন্তু তার আশে-পাশের সকলেরই ক্ষতি করে।

মাদকদ্রব্য এখন শহরের গণ্ডি পেরিয়ে গ্রাম-গঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঢুকে কালো থাবা বিস্তার করে বসেছে। মাদকের নেশা আত্মঘাতি, যা সমাজ দেশ মনুষ্যত্ব সর্বোপরি বিশ্বব্যাপী ডেকে আনছে বিপর্যয়। সকল বিবেকবান মানুষই মদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন।  কিন্তু কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। আমেরিকায় ১৯২০ সালে মদ নিষিদ্ধ হয়। কিন্তু মদ্যপায়ী ও মাদকাসক্তিদের চাপে ১৯৩৩ সালে মদ আবার বৈধ করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান প্রমাণ করে যে, ধুমপান ও ড্রাগের চেয়েও মদপান মানব সভ্যতার জন্য বেশি ক্ষতিকর। অথচ বর্তমান পাশ্চাত্য বিশ্ব ধুমপান ও ড্রাগের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও মদের বিরুদ্ধে সোচ্চার নয়। কারণ মদপান সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় বলেই তারা ধরে নিয়েছে। যদিও এইডস, ক্যান্সার ও অন্যান্য মরণব্যাধির চেয়েও মদ মারাত্মক সমস্যা।

শারীরিক কুফল:
মাদকসেবীদের শারীরিক কুফল শুরু হয় বেশ কিছু কাল পর। তখন তাদের হাত পা কাঁপে। কণ্ঠস্বর বিকৃত হয়, চেহারা ধূসর আকার ধারণ করে, পাকস্থলী কিংবা লিভারে সমস্যা হয়, হার্ট ব্লক, হার্ট অ্যাটাক হয়। যৌন ক্ষমতা হ্রাস হয়। আমাশায়, আলসার, কোষ্ঠকাঠিণ্য  ইত্যাদি রোগ হয়।

মানসিক কুফল:
মাদকের প্রভাবে মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কথা বলে। স্মরণ শক্তি হ্রাস, অস্থিরতা, খিটখিটে মেজাজ, অলসতা দায়িত্বহীনতা, পাগলামী, সমান বিবেচনা ক্ষমতা লোপ পায় এবং সময় জ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা ঘটে।

সামাজিক কুফল:
মাদক সেবিরা নানাবিধ অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে। সে যে কোনো সুযোগে অপরাধ জগতে প্রবেশ করে। বড়দের প্রতি অশ্রদ্ধাবোধ ও ছোটদের প্রতি স্নেহ কমে আসে। খবরের কাগজে জানা যায়, মাদকাসক্ত ছেলে স্বামীহারা বিধবা, মা তার একমাত্র উপার্জন বাড়ি ভাড়ার টাকা কখন ছেলের হাতে ছিনতাই হয়ে যায় সর্বদা থাকে আতঙ্কে। এমন কী নামাজ পড়া অবস্থায় কোরআন তেলাওয়াতরত সময়ও সেই নেশাগ্রস্ত ছেলেটি লাথি মারে মাকে। লাথি মারে পবিত্র কোরআন মজিদে। ছুরি ধরে জন্মদাতা বাবার বুকে। সে মা সবসময় আতঙ্কে থাকেন কখন লাঞ্ছিত হচ্ছেন, অপমানিত হচ্ছেন। কখন তিনি নিহত হচ্ছেন। কখন মাতাল হয়ে বাসায় এসে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করবে। সন্ত্রাসীর মতো জিম্মি করে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করবে এবং সামাজিক ভাবেও হবে লাঞ্ছিত-অপমানিত। 

আসলে মাদকাসক্তি হচ্ছে চারিত্রিক ব্যর্থতার উন্মত্ত প্রকাশ, যা সামাজিক শান্তি, সন্ধি, সহনশীলতা এবং ভ্রাতৃত্ববোধ নষ্ট করে দিয়ে চরম বিপর্যয় প্রতিষ্ঠা করে।

মাদকের ভয়ল থাবায় আক্রান্ত যুব সমাজ ও ছাত্র সমাজ:
যুব সমাজ ও ছাত্র সমাজ দেশের সম্পদ। তারা দেশের কল্যাণে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। যুবসমাজ ও ছাত্রসমাজ বিপদগামী হলে দেশ ও জাতির চরম অধ্ব:পতন নেমে আসে। মাদকের নেশায় তলিয়ে যাচ্ছে ছাত্র-যুবক তথা তরুণ প্রজন্ম। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম। মাদকের ভয়াল থাবায় ধ্বংসের মুখে আমাদের যুবসমাজ। উচ্চ বিত্ত থেকে শুরু করে নিম্ন বিত্ত শ্রেণির হাজার মানুষ আসক্ত হয়ে পড়ছে মাদকে। সর্বনাশা মাদকের দিকে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে ছাত্রসমাজ। হারিযে যাচ্ছে অন্ধকারে। অনেক ছাত্রের স্কুলব্যাগে বই খাতার সঙ্গে থাকছে মাদকদ্রব্য। পত্রিকার রিপোর্টে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন বাস টার্মিনাল, আবাসিক এলাকা, ফুটপাত, বস্তি, হাটবাজার, পার্কের আশপাশ ও আবাসিক হোটেলসহ সব স্পটে অবাধে বিক্রি হচ্ছে মাদকদ্রব্য। ক্ষমতাসীন দলের নাম ব্যবহার করে মাদক ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মাদক ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। পুলিশকে ম্যানেজ করে মাদক ব্যবসা চলে এমন অভিযোগও রয়েছে। জেলা উপজেলা থেকে গ্রাম পর্যন্ত মাদকের ছড়াছড়ি হলেও মাদক ব্যবসায়ীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

সরকারের মাদক বিরোধী অভিযান:
মাদকাসক্তি রোধে সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা ও কর্মসূচি আছে। এ খাতে বাজেট আছে। লোকবল খাটানো হচ্ছে। প্রচার-প্রচারণা মোটামোটি চলছে। সরকারের লক্ষ্য মাদক ব্যবসা সম্পূর্ণ নির্মূল করা। সেই লক্ষ্যে আইন সৃঙ্খলা বাহিনীকে পূর্ণদমে কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। রীতিমত এক যুদ্ধ। সরকারের ধারণা এ ব্যবস্থা কাজে আসবে। মদ্যপায়ীরা মদপান ছেড়ে দেবে। মাদক ব্যবসায়ীরা মাদক ব্যবসা ছেড়ে দেবে। ছাত্র সমাজ যুব সমাজ সাধারণ জীবন ফিরে পাবে।

সরকারের  সুফল:
মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান নিশ্চই প্রশংসার দাবি রাখে। যে মাদকাসক্তির কবলে পড়ে হাজার হাজার পরিবার বিপর্যস্ত হচ্ছে। সমাজ হচ্ছে কলুষিত। সমগ্র দেশের আইন শৃংঙ্খলা পড়ছে চরম হুমখির মুখে। তার ব্যাপারে শিথিলতা প্রদর্শনের কোনো সুযোগ নেই। যার কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে এসেছে।

সরকারের কুফল:
মাদক ব্যবসা গুরুতর পাপ হলেও মৌলিকভাবে হত্যাযোগ্য অপরাধ নয়। তাও আবার বিনা বিচারে। বিচারহীন যে কোনো তৎপরতায় সুযোগ সন্ধানীদের অনুপ্রবেশ সহজ হয়ে যায়। ফলে তারা প্রকৃত অপরাধীর পরিবর্তে নিরাপরাধ প্রতিপক্ষকে ফাঁসিয়ে দেয়। এভাবে বহু নিরাপরাধ ও নিরীহ লোক এ জাতীয় অবস্থায় ফেঁসে যায়।

খবরে প্রকাশ, যারা মারা পড়েছে তারা মাদক ব্যবসার রাঘব বোয়াল নয় বরং তাদের ছত্রছায়ায় থাকা চুনোপুঁটি মাত্র। এই চরম ব্যবস্থায় আসলে কতটুকু সুফল দিতে পারে? অনেকেই বলেছেন এর দ্বারা আসলেও উপস্থিত কিছু সুফল পাওয়া গেলেও কিন্তু এটা স্থায়ী কোনো সমাধান নয়।

একমাত্র ইসলামই এ সমস্যা সফলভাবে সমাধান করেছে। ইসলামই মদপান ও সকল প্রকার মাদকদ্রব্য হারাম করেছে। এবং ভয়ংকর কবিরা গুনাহ হিসেবে চিন্হিত করেছে। মদপান যেন সমাজে প্রশ্রয় না পায় এবং ঘৃণিত ও নিন্দিত থাকে এই জন্য ইসলামি আইনে মদপান, মাদকদ্রব্য গ্রহণ বা মাতলামির জন্য প্রকাশ্যে বেত্রাঘাতের শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে।

মদপানে ইহকালীন বিচার:
১. হাদিস : রাসূলে করিম (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি মদ পান করে তাকে বেত্রাঘাত কর। যদি চতুর্থ বার পান করে তবে তাকে হত্যা কর। হজরত জাবের (রা.) বলেন, পরে অনুরূপ এক ব্যক্তিকে রাসূল (সা.) এর নিকট আনা হলে তিনি তাকে প্রহার করেন। (তিরমিজি, নাসাঈ, মিশকাত)

২. হাদিস: হজরত যাবের বিন ইয়াযীদ (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) এর যুগে হজরত আবু বকর, হজরত উমর (রা.) এর যুগের প্রথম দিকে কোনো মদ্যপায়ী আসামী এলে আমারা হাত দিয়ে, চাদর, জুতা ইত্যাদি দিয়ে পিটাতাম। অত:পর হজরত উমরের (রা.) যুগের শেষ দিকে তিনি বেত্রাঘাত করেন। কিন্তু যখন মদ্যপান বৃদ্ধি পেতে থাকে তখন তিনি আশিটি বেত্রাঘাত করেন। (বুখারি, মেশকাত)

মদপানের পরকালীন শাস্তি:
ইমাম তিবী (রহ.) বলেন, সুরা মায়েদার ৯০, ৯১ নম্বর আয়াতে মদ নিষিদ্ধের পক্ষে সাতটি দলিল রয়েছে।
 ১. মদকে “রিজসুন’ বলা হয়েছে। যার অর্থ নাপাক বস্তু। আর নাপাক বস্তু হারাম। 
২. একে ‘মিন আমালিশ শাইতান’ শয়তানি কাজ বলা হয়েছে। যা করা নিষিদ্ধ। 
৩. বলা হয়েছে ‘ফাজতানিবুহু’ তোমরা এ থেকে বিরত হও। আল্লাহ যা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন তা নিঃসন্দেহে হারাম। 
৪. বলা হয়েছে ‘লা আল্লাকুম তুফলীহুন’ এতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হবে। অর্থাৎ যা থেকে বিরত থাকার মধ্যে কল্যাণ রয়েছে তাতে সম্পৃক্ত হওয়া অবশ্যই নিষিদ্ধ। 
৫. শয়তান মদ, জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে চায়। এ কথা চূড়ান্ত যে, যা কিছু  মানুষের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে তা নিঃসন্দেহে হারাম। 
৬. বলা হয়েছে আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে তোমাদের বিরত রাখে। এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, যা দ্বারা শয়তান মানুষকে আল্লাহ বিমুখ করে দেয়, নামাজ ও আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে সরিয়ে দেয় তা অবশ্যই হারাম। 
৭. ‘ফাহাল আনতুম মুনতাহুন’ অতএব তোমরা কী নিবৃত্ত হবে না।  অর্থ তোমরা নিবৃত্ত হও। অতএব আল্লাহ তায়ালা স্বীয় বান্দাদেরকে যে কাজ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে হারাম। 

হাদিস:
রাসূলে করিম (সা.) বলেছেন, দুই ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না। মাতা-পিতার অবাধ্যকারী ও মদপানকারী (নাসাঈ)। রাসূলে করিম (সা.) বলেছেন, ‘মদপানকারী জাহান্নামে ব্যাভিচারী নারীদের যৌনাঙ্গ থেকে নির্গত পানি পান করানো হবে। রাসূলে করিম (সা.) বলেছেন, মদের নেশায় অভ্যস্ত ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না’ (ইবনে মাজাহ)

সমাজে, রাষ্ট্রে ইসলামের পদ্ধতিতেই মাদকতা ও মাদকাসক্তি নির্মূল করা সম্ভব যদি আমরা ইসলামি অনুশাসন মেনে চলি। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।