• মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১০ ১৪৩১

  • || ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

সর্বশেষ:
যুদ্ধের অর্থ জলবায়ু পরিবর্তনে ব্যয় হলে বিশ্ব রক্ষা পেত- প্রধানমন্ত্রী দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড মেডিকেল কলেজের ক্লাস অনলাইনে নেয়ার নির্দেশ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ‘গণতান্ত্রিক রীতিনীতি না মানলে জনগণই বিএনপিকে প্রতিহত করবে’ লালমনিরহাটে হত্যা মামলায় বিএনপির দুই নেতা কারাগারে

সন্তানের জন্য বাবা মার দোয়া ও বদ দোয়ার প্রভাব

– নীলফামারি বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১৭ অক্টোবর ২০১৯  

নেতিবাচক প্রভাব: এক পরহেজগার ও বুজুর্গ ব্যক্তির কথা। তিনি আলেম ছিলেন না, কিন্তু আমল-আখলাক খুব ভাল ছিল। জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করতেন, নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়তেন এবং তাকবিরে উলার খুব পাবন্দি ছিলেন। তার মোট সন্তান ছিল ছয়জন। তিনজন মেয়ে ও তিনজন ছেলে। মৃত্যুর পূর্বে তিনি যে কষ্ট-যন্ত্রণা অনুভব করেছেন এবং নিজ সন্তানদের ব্যাপারে দুঃশ্চিন্তায় ভুগেছেন; তাতে আমাদের সকলের জন্য শিক্ষা রয়েছে। 

তার মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলেও ছেলেদের তখনো বিয়ে হয়নি। তন্মধ্যে ছোট ছেলে তার জন্য বদনামের কারণ হয়ে গিয়েছিল। পুরো গ্রামবাসী তার প্রতি বিরক্ত ও অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। এক পর্যায়ে তিনি কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন, ‘আমার স্মরণ নাই যে আমি কী এমন গুনাহ করেছি, যার কারণে আমাকে এমন দিন দেখতে হলো!’

তার সমবয়সীদেরও বক্তব্য ছিল যে, তিনি ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত নম্র-ভদ্র, হালাল-হারাম বিচার করে চলতেন এবং মদ, যিনা ইত্যাদি কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতেন।

একদিকে তো তার অবস্থা ছিল ইতিবাচক, কিন্তু অজানা কারণে তার সন্তানের অবস্থা হয়ে গেল নেতিবাচক। অনেক চিন্তা করার পরেও ব্যাপারটা বুঝে আসছে  না। পরিশেষে তার সমকালীন আরেকজন বুজুর্গের মাধ্যমে ব্যাপারটা বুঝে আসে। তিনিও ছিলেন সেই বুজুর্গের বন্ধু। একসঙ্গে চলাফেরা ছিল তাদের। তিনি তার বন্ধু সম্পর্কে বললেন, যুবক বয়সে তিনি যখন মসজিদে নামাজ পড়তে যেতেন, তখন রাস্তায় দুষ্টু ছেলেরা অনেক সময় খেলাধুলা করতে গিয়ে তাকে বিরক্ত করতো। তখন তিনি তাদেরকে বকাঝকা করতেন এবং অভিশাপ দিয়ে বলতেন, ‘তোদেরকে কোন বদমাশ বাপ জন্ম দিয়েছে? তোদের বাপ কী হারাম উপার্জন করে তোদেরকে খাওয়ায় যে এমন দুষ্টামি করিস?’ এমনকী কারো ব্যাপারে কোনো অপছন্দনীয় ও বিশ্বাস অযোগ্য কথা শুনলেই বলতেন, ‘বদমাশের ছেলে তো বদমাশই হবে।’ কোনো বাচ্চাকে দুষ্টামি করতে দেখলে প্রকাশ্যে বলতেন, ‘এই ছেলের পিতাও যুবক বয়সে এমন কাজ করেছিল, তাই ছেলেও তার মতো হয়েছে।’

মোটকথা, অন্যের সন্তানকে অভিশাপ দিতে এবং কাউকে কোনো বিষয়ে লজ্জা দিতে তিনি কোনো সংকোচ করতেন না।

তার সম্পর্কে কথাগুলো শুনে তৎক্ষণাৎ রাসূলুল্লাহ (সা.) এর এই হাদিস মনে পড়ে গেল, ‘যে ব্যক্তি তার কোনো ভাইকে কোনো গুনাহর কারণে লজ্জা দেবে, সে ওই কাজ করার আগে মৃত্যু বরণ করবে না’।

রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো বলেছেন, ‘কারো বিপদে খুশি হয়ো না। (এমনটি করলে) আল্লাহ তার ওপর রহম করবেন আর তোমার ওপর সে বিপদ চাপিয়ে দেবেন’। তিনি আরো ইরশাদ করেন, ‘যে তার ভাইয়ের দোষ গোপন রাখবে, আল্লাহ তায়ালা তার দোষ গোপন রাখবেন’।

আমি মনে মনে ভাবলাম, আমার বন্ধুর সন্তানদের এই দুরাবস্থা হয়তো অন্যকে অভিশাপ ও প্রকাশ্যে লজ্জা দেয়ার কারণেই হয়েছে। আর সেই বুজুর্গ বন্ধু আমাকে এটাও বললেন যে, তিনি তার সন্তানদের প্রতিপালনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত কঠোরতা অবলম্বন করতেন। তাদের থেকে কোনো গর্হিত কাজ তিনি একদম সহ্য করতেন না। কোনো অপরাধ করলে প্রহার করার পাশাপাশি তাচ্ছিল্য করে শয়তান, ইবলিস, অভিশপ্ত ইত্যাদি বলে গালিগালাজ করতেন। আমি মনে মনে বললাম, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা বুজুর্গ ব্যক্তির এই গালিগুলো তার সন্তানের ক্ষেত্রে কবুল করেছেন। এ কারণেই তো তার সন্তানদের এই শোচনীয় ও বর্ণনাতীত অবস্থার সম্মুখীন হতে হলো। 
কারণ, যেমনিভাবে সন্তানদের ক্ষেত্রে তার মা-বাবার ভালো দোয়া তাড়াতাড়ি কবুল হয়, ঠিক তেমনি বদ দোয়াও তাড়াতাড়ি কবুল হয়ে যায়। এ কারণে ভুলেও কখনো সন্তানদেরকে শাসন করার সময় রাগের মাথায় কোনো ধরনের বাজে নাম মুখে না আনা উচিৎ। খোদা না করুন, যদি তা দোয়া কবুলের সময় হয়, তাহলে ওই নামের প্রভাব তার ওপর পড়তে থাকবে। আমার মনে আরো একটি কথা উদয় হলো, যদি সে নিজ সন্তানের তরবিয়তের জন্য আল্লাহ তায়ালার শেখানো এই কোরআনি আয়াত দ্বারা দোয়া করতো, তাহলে তাকে এই দিন দেখতে হতো না। আয়াতের অর্থ হলো, ‘হে আল্লাহ, আপনি আমাকে এমন স্ত্রী ও সন্তান দান করুন, যে হবে আমার চোখের শীতলতা এবং আমাদেরকে আপনি মুত্তাকিনদের ইমাম বানিয়ে দিন’।

ইতিবাচক প্রভাব: মুফাক্কিরে ইসলাম হজরত মাওলানা আবুল হাসান আলি নদবি (র.) এর কথা আমরা সবাই শুনেছি। প্রায় সতের বছর পূর্বে রমজানের তেইশতম রাতে ৮৬ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। মহান আল্লাহ তায়ালা তার দ্বারা ইসলামের এমন সব বড় বড় কাজ করিছেয়েন, যার নজির পূর্বের ইতিহাসে খুব কমই পাওয়া যায়। আল্লাহ তাঁর হাজারো বান্দার মধ্যে তাকে মাকবুলিয়্যাতের দরজায় উন্নীত করেছিলেন। তিনি যে আল্লাহ তায়ালার একজন খাঁটি ও প্রিয় বান্দা ছিলেন, বেশ কিছু নিদর্শন দ্বারা তা সহজে বুঝা যায়। তিনি জুমার দিন রোজা অবস্থায় জুমার কিছুক্ষণ পূর্বে সূরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করতে করতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্রে তার গায়েবানা জানাজা পড়া হয়েছিল। রমজানের তেইশতম রাতে হারামে মক্কায় সাতাইশ লাখ এবং হারামে মদিনায় পনেরো লাখের বেশি মুসলমান তার গায়েবানা জানাজায় শরিক হয়েছিল এবং মাগফিরাতের জন্য দোয়া করেছিল। এমন সৌভাগ্য ও মাকবুলিয়্যাত খুব কম মানুষের ভাগ্যেই জোটে। 

তিনি ছাত্র অবস্থায় খুব বেশি মেধাবী ও চালাক-চতুর ছিলেন না। ছাত্র হিসেবে অন্য মধ্যম পর্যায়ে ছাত্রদের মতোই ছিলেন। কিন্তু এর পরেও আল্লাহ তায়ালা তার থেকে দ্বীনের যে কাজ করিয়ে নিয়েছেন, তা সত্যি আশ্চর্যজনক। যখন তাকে আল্লাহ প্রদত্ত এই যোগ্যতা ও বিশেষত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন করা হতো, তখন তিনি বলতেন, আমার মোহতারামা আম্মাজানের নেক দোয়াই আমাকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। তার দোয়ার বরকতেই সফলতা এসেছে জীবনে। তার মাতা অনেক বড় আবেদা জাহেদা ও জাকেরা ছিলেন। তিনি ৯৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতিদিন দুই রাকাত সলাতুল হাজত নামাজ পড়ে তার সন্তানের জন্য এই বলে দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! আমার আলি থেকে যেনো কখনো কোনো গুনাহর কাজ না হয়ে যায়। জীবনের সকল ক্ষেত্রে আপনি তাকে সঠিক পথে পরিচালনা করবেন’।  মৃত্যুর পূর্বে ছেলেকে তিনি এই বলে অসিয়ত করেছিলেন, ‘আলি, তুমি প্রতিদিনের আমলে এই দোয়াকেও শামিল করে নিবে, ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাকে আপনার নেক বান্দাদের প্রদত্ত অংশগুলো থেকে উত্তম অংশ আমাকে দান করুন’।

তার মা তার জন্মের আগে একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন। স্বপ্নের ব্যাখ্যা তিনি তার মৃত্যুর আগে দেখে গিয়েছিলেন। তার স্বপ্ন ছিল, কোনো একজন অদৃশ্য ব্যক্তি তার মুখে পবিত্র কোরআনের এই আয়াত জারি করে দিয়েছিল, ‘আমি তোমার চোখের শীতলতার জন্য যে গোপন খাজানা লুকিয়ে রেখেছি, তার ধারণাও তোমার নেই’। তার মা তাকে খুব উত্তম পদ্ধতিতে তরবিয়ত দিয়েছিলেন। যদি তার দ্বারা কোনো চাকর বা খাদেমের ছেলে-মেয়েদের ওপর সামান্য বাড়াবাড়ি হয়ে যেতো, তাহলে তিনি তাকে কেবল শাসনই করতেন না, বরং সেই চাকর ও খাদেম দ্বারা তাকে প্রহার করতেন। এর ফলে শৈশবকাল থেকেই মাওলানা নদবি (র.) এর মন থেকে সকল প্রকার জুলুম, অত্যাচার এবং অন্যকে কষ্ট দেয়ার প্রবণতা দূর হয়ে গিয়েছিল। তিনি যদি এশার আগে ঘুমিয়ে পড়তেন তাহলে তার মা নামাজের জন্য জাগিয়ে দিতেন, সকাল সকাল ফজরের জামাতে পাঠাতেন এবং ফজরের পর কোনোদিন কোরআন তেলাওয়াত মিস হতে দিতেন না।
 
এই ছিল আমাদের পূর্ববর্তী বুজুর্গানে দ্বীনের সন্তান লালন-পালনের নীতি। আমাদেরও উচিত ছিল প্রতিদিন দু’রাকাত সলাতুল হাজত পড়ে নিজ সন্তানের জন্য দোয়া করা। দৈনিক তো দূরের কথা, জীবনেও হয়তো কখনো সলাতুল হাজত পড়ে নিজ সন্তানের ইসলাহের জন্য দোয়া করিনি। অথচ আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সন্তানের জন্য উত্তম নাম, উত্তম দোয়া এবং দোয়ার আদব শিখিয়েছেন। সন্তান বিপথগামী হলে, পাপাচারে লিপ্ত হলে, কথা না মানলে আমরা পেরেশান হয়ে যাই। কিন্তু কখনো তাদেরকে সঠিক পথে ফিরে আসার কথা বলি না। এ কারণে তাদের অবস্থাও কখনো পরিবর্তন হয় না। কখনো কী আমরা মহান আল্লাহর সামনে কায়মনো বাক্যে, মন উজাড় করে আমাদের সন্তানের নাম ধরে সঠিক পথে ফিরে আসার দোয়া করেছি যে, ‘হে আল্লাহ! আপনি তাকে সঠিক পথ দেখান? এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের মধ্যে অধিকাংশেরই ‘না’ হবে। তাই আসুন আজ থেকে আমাদের সন্তানদের উত্তম তরবিয়তের প্রতি লক্ষ্য রাখি।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের বলে দিয়েছেন, উত্তম স্ত্রী ও উত্তম সন্তানের জন্য তাঁর কাছে কীভাবে দোয়া করবো। তিনি ইরশাদ করেন, ‘হে আল্লাহ আপনি আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তান দান করুন, যারা আমার চোখের শীতলতা হবে, আর আপনি আমাদেরকে মুত্তাকিনদের ঈমাম বানিয়ে দিন’।

আরো ইরশাদ করেছেন, ‘হে আল্লাহ আপনি আমাকে নামাজ কায়েমকারী বানিয়ে দিন এবং আমার বংশধরকেও। হে আল্লাহ! আপনি এই দোয়া কবুল করে নিন’।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আসুন আমরা ওয়াদা করি, অন্ততপক্ষে সপ্তাহে একবার আমরা সলাতুল হাজত পড়ে আমাদের সন্তানদের জন্য দোয়া করবো। যদি তাদের জন্য কায়মনো বাক্যে দোয়া করতে থাকি তাহলে ইনশাআল্লাহ আশা করা যায় কয়েকদিনের মধ্যে আমাদের সন্তানদের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আর আমাদের সন্তান কেবল আমাদের জন্যই নয়, বরং পুরো উম্মতের জন্য হেদায়েতের মাধ্যম হবে ইনশাআল্লাহ।