• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

সমাজে স্থিতিশীলতার জন্য মহানবী (সা.) এর আমল

– নীলফামারি বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৫ জানুয়ারি ২০২০  

ইসলামে মানুষের চারিত্রিক গুণগুলোকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এক ভাগ হচ্ছে ভালো গুণ। যেমন বিনয়, আত্মসংযম, দান, উদারতা ও বাহাদুরি ইত্যাদি।
আরবি ভাষায় এগুলোকে বলা হয় ‘আখলাকে ফাযিলা’ অর্থাৎ মহৎ চরিত্র। আরেক ভাগ হচ্ছে খারাপ চরিত্র। এর মধ্যে আছে কৃপণতা, অহংকার, ক্রোধ, কুধারণা, আত্মকেন্দ্রিকতা ও সংকীর্ণতা ইত্যাদি। 
ভালো গুণগুলোকে বিকশিত করা ও খারাপগুলোকে দমন করার জন্য ইসলাম অনেক গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলামের চৌদ্দশত বছরের ইতিহাসে সূফিবাদের যে ধারা পাওয়া যায়, এর মূল উদ্দেশ ছিলো মানুষের ভেতর ভালো গুণ অর্জনের আগ্রহ তৈরি করা আর খারাপ গুণ দূর করার জন্য চেষ্টা করা।

বর্তমানে বিভিন্ন কারণে মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। অন্যের কল্যাণ কামণা ও বিপদ-আপদে পাশে দাঁড়ানোর চিন্তা আমাদের থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে। মানুষকে ঠকিয়ে টাকা কামানো, বিপদে ফেলে অর্থ আদায় এখন পেশায় রূপ নিয়েছে। এর জন্য আমাদের কলুষিত আত্মাই দায়ী। সম্পদের সীমাহীন বাসনা আমাদেরকে এ পথে নিয়ে এসেছে। ইসলামের আদর্শকে আকড়ে ধরলে আশা করা যায় এই রোগ থেকে আমরা মুক্তি পাবো। সমাজের অশান্ত পরিবেশ স্থিতিশীল হয়ে আসবে।

অন্যের জন্য কল্যাণ না চাইলে মুমিন হওয়া যায় না: কল্যাণকামিতা এমন এক গুণ, মানুষের মাঝে এই গুণ চলে আসলে সব রকমের দ্বন্দ-কলহ বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ, মানুষের মাঝে দ্বন্দ-কলহের সূত্রপাত হয় যখন প্রত্যেকে নিজের স্বার্থ বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেয়। অন্যের কল্যাণের বিষয়টিকে উপেক্ষা করে চলে। মানুষ এই মূলনীতি সামনে রেখে যদি চলে যে, নিজের জন্য যে বিষয়কে অকল্যাণ মনে করবো, এটাকে অন্যের জন্যও অকল্যাণকর মনে করবো, অন্যের থেকে যে আচরণ কামণা করি না, অন্যের জন্যও আমার থেকে সে ধরনের আচরণ চাইবো না, তাহলে ঝগড়া বিবাদের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। এই কথাটি রাসুল (সা.) আমাদেরকে খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়েছেন।

হজরত আনাস (রা.) এর সূত্রে হজরত নবী করিম (সা.) থেকে বর্ণীত হয়েছে, রাসূল (সা.) বলেন, তোমরা অন্যের জন্য ওই বিষয় পছন্দ করবে, যা তোমরা নিজেদের জন্য পছন্দ করে থাক।’ (সহিহ বোখারী-১৩)। এই হাদিসের শিক্ষা হচ্ছে, যখন কোনো কাজ করার বিষয় আসবে, সেখানে শুধু নিজের স্বার্থের বিষয়টি বিবেচ্য হবে না। বরং প্রতিপক্ষের স্বার্থের বিষয়টিও দেখতে হবে।

ব্যবসায়ীকে দেখতে হবে, ক্রেতার জায়গায় আমি হলে এই লেনদেনে বিক্রেতার থেকে আমি কেমন আচরণ প্রত্যাশা করতাম? ব্যবসায়ীকে ক্রেতার সঙ্গে সেভাবেই লেনদেন করতে হবে। কনো কোনো বর্ণনায় প্রতিবেশীর কল্যাণ কামনার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না প্রতিবেশীর জন্য ওই বিষয় পছন্দ কর যা নিজের জন্য পছন্দ কর।

প্রতিবেশীর কথা বিশেষভাবে উল্লেখের কারণ হয়তো এটা হতে পারে যে, মানুষ দূরের হলে অনেক সময় তার ভালো চাওয়া, কল্যাণ কামনা করা হলেও প্রতিবেশীর ক্ষেত্রে এর বিপরীত। এক প্রতিবেশী, তার অপর প্রতিবেশীর সঙ্গে দ্বন্দ-কলহেই বেশি লিপ্ত থাকে। যার দরুণ পরস্পর ক্ষতি করার একটা চেষ্টা থাকে। একজনের সফলতা দেখে অন্যজন খুশির চেয়ে কষ্টই বেশি পায়। তাই রাসূল (সা.) প্রতিবেশীর কল্যাণ কামনার কথা বিশেষভাবে এনেছেন।

ইসলাম মানুষের কল্যাণ কামনার ধর্ম: হজরত তামিমে দারি (রা.)। হুজুর (সা.) এর একজন প্রসিদ্ধ সাহাবি। তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, দ্বীন হচ্ছে কল্যাণ কামনার নাম। উপস্থিত সাহাবাগণ আরজ করলেন, কাদের জন্য কল্যাণ কামনার নাম দ্বীন? রাসূল (সা.) বলেন, আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর কিতাব ও রাসূলের কল্যাণ কামনার নাম হচ্ছে দ্বীন ইসলাম। সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান সমাজের দায়িত্বশীল ও সাধারণ মুসলমানদের কল্যাণের বিষয়টিও দ্বীনের অন্তর্ভূক্ত। (সহীহ মুসলিম-৯৫)।

হাদিসবেত্তাগণ এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেছেন, আল্লাহ তায়ালার জন্য কল্যাণ কামনার অর্থ হচ্ছে তার ওপর ঈমান আনা। আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে কাউকে শরীক না করা। তার গুণাবলী সম্পর্কে কোনো বিকৃত ব্যাখ্যা না দেয়া। তিনি সব ধরনের অসম্পূর্ণতা ও ত্রুটি থেকে পবিত্র সে স্বীকৃতি দেয়া। তার জন্যই কাউকে ভালবাসা এবং কারো সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করা। যারা তাঁর অনুগত বান্দা তাদের সঙ্গে সুস্পর্ক রাখা। অবাধ্যদের থেকে দূরে থাকা। আল্লাহর দেয়া নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা ইত্যাদি। আল্লাহর জন্য কল্যাণ কামনার কথা বলা হলেও আসলে এগুলো মূলত বান্দার নিজেরই কল্যাণ কামনা। আল্লাহ তায়ালা বান্দার কল্যাণ কামনা থেকে অমুখাপেক্ষী।

হাদিসে আল্লাহর কিতাবের কল্যাণ কামনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহর কিতাব দ্বারা উদ্দেশ হচ্ছে আল কোরআন। কোরআনের কল্যাণ কামনার অর্থ হলো, কোরআনের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা যে, এই গ্রন্থ মহান আল্লাহ তায়ালার নাজিলকৃত, এর সমতুল্য মানুষের বানানো কোনো গ্রন্থ হতে পারে না। কোরআনের বিধান মোতাবেক মুসলমানের জীবন যাপন করাও কোরআনের কল্যাণ কামনার অংশ।

রাসূলের কল্যাণ কামনার দ্বারা উদ্দেশ হচ্ছে, নবী হিসেবে তাঁর ওপর ঈমান আনা এবং তার সুন্নায় বর্ণিত সব বিষয় মেনে জীবন যাপন করা। মুসলিম সমাজের নেতৃবৃন্দের কল্যাণ কামনার দ্বারা উদ্দেশ

হলো, সত্য ও ন্যায়ের ক্ষেত্রে তাদেরকে সহযোগিতা করা। তাদের বিরুদ্ধে কাউকে উস্কে না দেয়া। বিদ্রোহ না করা। ভুলগুলোর সংশোধন করা। সাধারণ মানুষের কল্যাণ কামনাকেও দ্বীন বলা হয়েছে। আফসোস আজকের মুসলমান দ্বীন বলতে শুধু নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাতকেই বুঝে। পরস্পর কল্যাণ কামনাও দ্বীন, এ ধারণা মুসলমানের দেমাগ থেকে বের হয়ে গেছে। তাই পরস্পর ঝগড়া ও দ্বন্দ-কলহকে নিজের ঈমান, আমলের জন্য মারাত্মক কিছু মনে করছে না।

মানুষের কল্যাণ কামনার ওপর রাসূল (সা.) এর বায়াত: হজরত জারির (রা.)। নবী করিম (সা.) এর একজন প্রসিদ্ধ সাহাবি। তিনি রাসূল (সা.) এর কাছে বাইয়াত হয়েছিলেন। বাইয়াতের বিষয় ছিলো, নামাজ কায়েম করা, জাকাত দেয়া ও সব মুসলমানের কল্যাণ কামনা করা। (সহীহ মুসলিম-৯৭)। উল্লেখ, রাসূল (সা.) এর কাছে মুসলমানরা জিহাদের বাইয়াত হতো। আবার নেক আমল করার ওপরও কেউ কেউ বাইয়াত হতো। যেমন: আল কোরআনে এসেছে, ‘হে নবী! যখন মুমিন নারীরা আপনার কাছে আসে এই বিষয়গগুলোর ওপর বাইয়াত হতে যে, তারা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করবে না, ব্যভিচার করবে না... তাহলে আপনি তাদেরকে বাইয়াত করে নেন।’ (সূরা: মুমতাহিনা, আয়াত: ১২)।

পূর্বোক্ত হাদিস দ্বারা প্রমাণ হয় সাহাবায়ে কেরাম, নামাজ ও জাকাতের সঙ্গে মুসলমানের কল্যাণ কামনার ওপরও বাইয়াত হতেন। এর অর্থ দাঁড়ায় সাহাবারা মুসলমানের কল্যাণ কামনাকে খুবই গুরুত্ব দিতেন। হজরত জারির (রা.) এর আরেক বর্ণনায় এসেছে, তিনি শুধু মুসলমানের কল্যাণ কামনার বিষয়ে রাসূল (সা.) এর হাতে বাইয়াত হতেন। কনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, কথা মানা ও আনুগত্যের ওপর বাইয়াত হতেন এবং মুসলমানের কল্যাণ কামনার ওপর। এ সব হাদীস দ্বারা প্রমাণ হয় মুসলমানের কল্যাণ কামনা কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ।

কর্মচারী মালিকের কল্যাণ কামনা করার ফজিলত: বর্তমান সময়ে শ্রমীক ও মালিকের মাঝে খারাপ সর্ম্পক একটি স্বাভাবিক বিষয়। মালিকরা চায় শ্রমীকদেরকে ঠকাতে। শ্রমীকরা চেষ্টা করে মালিকের কাজে ফাঁকি দিতে। এখানে প্রত্যেকে যদি একে অপরের কল্যাণ কামনা করতো তাহলে এই সমস্যা হতো না। ইসলাম এ ব্যাপারে খুব সুন্দর নির্দেশ জারি করেছে।

রাসূল (সা.) বলেন, কোনো গোলাম মালিকের কল্যাণ কামনা করলে এবং আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করলে দ্বীগুণ ছওয়াব পাবে। (সহিহ বোখারী ও মুসলিম)। এই হাদিসের ব্যাখ্যায় মনজুর নুমানী (রাহ.) বলেন, ‘মালিকদেরকে রাসূল (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন অধীনস্তদের সঙ্গে ভালো আচরণ করতে আর অধীনস্তদের নির্দেশ দিয়েছেন মালিকের কল্যাণ কামনা করতে। আমাদের সময়ে অশান্তির মূল কারণ হচ্ছে, প্রত্যেকে অপরের হক আদায়ের ব্যাপারে গাফেল। অন্যদিকে নিজের হক আদায়ের ব্যাপারে যে কোনো পদ্ধতি অবলম্বনকে জায়েজ মনে করে।’ (মাআরেফুল হাদিস, খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা-৩২৪)। দ্বীগুণ ছওয়াবের কারণ হচ্ছে, মানুষ অন্যের অধীনে থাকলে অনেক কষ্ট করে দ্বীনের কাজ করতে হয়। সওয়াবের এক অংশ হচ্ছে ইবাদতের জন্য আরেক অংশ অতিরিক্ত কষ্ট সহ্য করে ইবাদত করার জন্য।

সিরাতের রাসূলের আলোকে মানুষের কল্যাণ কামনা: রাসূল (সা.) এর জীবনিতেও উক্ত বিষয়ের গুরুত্ব পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন, রাহমাতুল্লিল আলামিন তথা সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য রহমত। তিনি বহু নির্যাতন সহ্য করেছেন, কিন্তু কখনো কারো প্রতি ক্রোধান্বিত হননি। সর্বদা মানুষের কল্যাণ চেয়েছেন। তায়েফের ময়দানে যখন তাকে নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করা হয়, হজরত জিবরাইল (আ.) এসে অনুমতি চাইলেন যে, আপনি চাইলে তায়েফের দু,পাশের পাহাড়গুলোকে এক সঙ্গে করে তায়েফবাসীকে নিশ্চিহ্ন করে দেবো। তখন রাসূল (সা.) বলেন, তারা না বুঝে আমার সঙ্গে এরূপ আচরণ করেছে। আমাকে রহমত হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে, মানুষের বিনাশকারী হিসেবে নয়। এ রকমভাবে মানুষের কল্যাণের জন্য তিনি (সা.) সবর্দা নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন।

একবার মদিনার বাইরে আওয়াজ হলে মদিনাবাসী ভয় পেয়ে সে দিকে রওয়ানা হয়। পথিমধ্যে রাসূল (সা.) এর সঙ্গে সাক্ষাত হয়। তিনি সবার আগে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সংবাদ নিয়ে মদিনায় ফিরছিলেন। ঘটনা ঘটেছিলো রাতের বেলায়। 

হিজরতের পর রাসূল (সা.) দেখেন, মদিনাবাসী খেজুর গাছে বেশি খেজুর হওয়ার জন্য পুরুষ গাছের মুকুল এনে লাগাচ্ছে। রাসূল (সা.) উক্ত বিষয়টি অনর্থক মনে করে মদিনাবাসীকে তা থেকে বারণ করেন। পরের বছর খেজুর কম হলে রাসূল (সা.) আনসারদেরকে বলেন, তোমরা দুনিয়া সম্পর্কে ভালো জানো। অতএব আগের মতো করো। এখানে মানুষের কল্যাণে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।

সাহাবায়ে কেরামের মাঝে এমন অনেকে ছিলেন, যারা নিজেদের সমস্ত সম্পদ এমন কী জীবন পর্যন্ত অন্যের জন্য দিতে প্রস্তুত হয়ে যেতেন। ইয়ারমুকের যুদ্ধে আহত সাহাবাগণ নিজেরা পানি পান না করে অন্যের জন্য দেয়াও অন্যের কল্যাণে কোরবানির দৃষ্টান্ত।