• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

সর্বশেষ:
ইসরায়েলের হামলার পর প্রধান দুটি বিমানবন্দরে ফ্লাইট চলাচল শুরু। ইসরায়েল পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইরানে।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

– নীলফামারি বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২০ জানুয়ারি ২০২০  

নিরঞ্জন রায়

আমাদের সমাজে অনেক গুণী মানুষই নীরবে নিভৃতে থাকতে বেশি পছন্দ করেন। তেমনি একজন আদর্শ শিক্ষক ছিলেন সিরাজগঞ্জ সরকারী কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক ফণীন্দ্র নাথ বসাক। যিনি সকলের কাছে শ্রদ্ধেয় ফণী স্যার হিসেবেই বেশি পরিচিত। অধ্যাপক ফণী স্যার গত ৯ জানুয়ারি ৯৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। আমরা তার আত্মার শান্তি কামনা করি। সেইসঙ্গে কৃতজ্ঞতা জানাই প্রয়াত শিল্পপতি মফিজ তালুকদারের ছেলে ও তার পরিবারবর্গকে, যারা সুযোগ্য ছাত্র হিসেবে ফণী স্যারের প্রতি যে সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালবাসার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা বর্তমান যুগে বিরল।

ফণী স্যার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করে শিক্ষকতা শুরু করেন সিরাজগঞ্জ কলেজে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে। তিনি হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সিরাজগঞ্জ কলেজ একটি বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল এবং শিক্ষকদের বেতন-ভাতাও ছিল খুব নগণ্য। সে সময় ফণী স্যার ইচ্ছে করলে অন্য কোন ভাল চাকরি জোগাড় করে পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা আনতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেদিকে না গিয়ে শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। কেননা তিনি বিশ্বাস করতেন যে, একজন আদর্শ শিক্ষকের চেয়ে বড় কিছু হতে পারে না। দেশ স্বাধীন হবার পরও দীর্ঘদিন এই কলেজ সরকারী হয়নি। ফলে তাকে সারাটা জীবনই এক প্রকার আর্থিক টানাটানির মধ্য দিয়ে চলতে হয়েছে। পরবর্তীতে কলেজ যখন সরকারী করা হলো, তখন তিনি তার কর্মজীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তাই চাকরি সরকারী হবার কারণে তিনি খুব বেশি লাভবান হতে পারেননি। তবে সরকারী কলেজের অধ্যাপক হিসেবে অবসরে যেতে পেরেছেন এবং সেইসঙ্গে কিছু সরকারী পেনশন পেয়েছেন, এটাই ছিল তার বড় প্রাপ্তি ও সান্ত¡না।

আর্থিক কষ্ট থাকলেও এ নিয়ে তার কোন আক্ষেপ ছিল না। কারণ তিনি জীবনে ছাত্রছাত্রী এবং তাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে এত শ্রদ্ধা ও ভালবাসা পেয়েছেন, যার কাছে আর্থিক কষ্ট তেমন কিছুই না। তিনি একজন শিক্ষক হিসেবে তার আদর্শের সঙ্গে কখনই আপোস করেননি। তার সুদীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে অসংখ্য যোগ্য ছাত্রছাত্রী গড়ে তুলেছেন, যারা দেশ-বিদেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং এখনও করে চলেছেন। তার সকল ছাত্রছাত্রীই ফণী স্যারকে একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে জানে এবং এজন্য তারা গর্ববোধ করে। তারা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেন যে, ফণী স্যার ছাত্রদের মাঝে পাঠ্যসূচীর জ্ঞানদানে যতটা গুরুত্ব দিতেন, তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন ছাত্রদের মাঝে মূল্যবোধ জাগ্রত করে তুলতে। একজন আদর্শ মানুষ হতে হলে যেসব গুণাবলীর চর্চা করা প্রয়োজন, তা তিনি সফলভাবেই ছাত্রদের মাঝে রপ্ত করাতে পেরেছিলেন। এসব কারণে ফণী স্যার অবসরে যাবার দুই যুগ পরেও তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল স্তরের মানুষের ব্যাপক উপস্থিতি ঘটে। শিক্ষাদানের অপরিসীম পারদর্শিতা, সততা এবং আদর্শের কারণে তিনি কখনও মাথা নিচু করে বা গলার স্বর নরম করে কথা বলেননি। আমি সিরাজগঞ্জের ছেলে হওয়া সত্ত্বেও সিরাজগঞ্জে পড়ালেখা করিনি বিধায় এই গুণী শিক্ষকের সরাসরি ছাত্র হবার সৌভাগ্য হয়নি। তবে আমার অনেক নিকটাত্মীয়ই তার সরাসরি ছাত্র ছিলেন। বিশেষ করে আমার শ্বশুর প্রফেসর রবীন্দ্রনাথ দে ফণী স্যারের কলেজে অধ্যয়ন করেছে। পরবর্তীতে শিক্ষাজীবন শেষ করে সেই কলেজেই ফণী স্যারের অনুজ হিসেবে অনেকদিন একসঙ্গে অধ্যাপনা করেছেন। তিনিও ফণী স্যারকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করেন এবং সবসময় স্যার বলেই সম্বোধন করেন। মূলত আমি তার কাছ থেকেই ফণী স্যার সম্পর্কে কিছুটা জানতে পেরেছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি স্যারের সঙ্গে দু-একবার সাক্ষাত করার সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু তখন তিনি একজন অশীতিপর বৃদ্ধ। তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তার কাছ থেকে বেশি কিছু জানা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে সিরাজগঞ্জের ভূমিপুত্র পাটীগণিতের জনক বলে খ্যাত যাদব বাবুর ব্যাপারে ফণী স্যারের কাছ থেকে অনেক কিছু জানার খুব ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সেটি আর হয়ে ওঠেনি।

ফণী স্যারের আরও একটি বড় গুণ যে, তিনি দেশকে অসম্ভব ভালবাসতেন এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে তার বিশ্বাস ছিল অনেক ওপরে। আমরা সবাই দেশকে ভালবাসি। তবে স্যারের মধ্যে দেশপ্রেমের গভীরতা ছিল অনেক বেশি। তিনি বাংলাদেশকে যে শুধু ভালবাসতেন তাই নয়, তিনি এই দেশ ছেড়ে কোথাও যেতে চাননি। সেই ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের পর থেকে বিভিন্ন সময় মানুষকে দলে দলে দেশ ত্যাগ করতে দেখেও তিনি কখনও দেশ ছেড়ে অন্যত্র যাবার কথা কল্পনাও করেননি। এ নিয়ে তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মতপার্থক্যও ছিল যথেষ্ট। এজন্য তিনি নিকটজনদের কাছ থেকেও দূরে সরে গিয়েছিলেন। তবু তিনি দেশের মাটি ছেড়ে যাবার কথা ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি।

দেশে বিভিন্ন সময় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনার কারণে তার স্ত্রী-সন্তান দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়, যা তিনি মেনে নিতে পারেননি। তিনি হয়ত তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, এগুলো সাময়িক কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিছুদিন পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। এজন্য নিজের দেশ ছেড়ে যাবার কথা কোনভাবেই চিন্তা করা উচিত নয়। দেশত্যাগের ঘটনা যত না হয় চিন্তাভাবনা ও বিচার-বিশ্লেষণ করে, তার চেয়ে বেশি হয় হুজুগে। সেই হুজুগে পড়ে স্যারের কথা অমান্য করে তার স্ত্রী-সন্তান বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেলেও ফণী স্যার তার পরিবারের সঙ্গী না হয়ে তার প্রিয় মাতৃভূমি সিরাজগঞ্জেই থেকে যান। ফণী স্যার অবসরে যাবার পর অনায়াসে চলে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। বরং সিরাজগঞ্জে নিঃসঙ্গ হিসেবেই থেকে গেছেন। তার দূরের ও কাছের অনেক আত্মীয়স্বজন সিরাজগঞ্জে থাকলেও সেখানে ফণী স্যার যে সম্মানের সঙ্গে থাকতে পারবেন না, তা তিনি নিজে না বুঝলেও, তার দুই যোগ্য ছাত্রের বাবা মফিজ তালুকদার যথার্থই বুঝেছিলেন। আর এ কারণেই মফিজ তালুকদার ফণী স্যারকে উপযুক্ত মর্যাদা ও সম্মান দিয়ে তার নিজের বাসায় নিয়ে এসে স্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেন।

মফিজ তালুকদার ছিলেন সিরাজগঞ্জের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি। তিনি তার ছেলেদেরকে ধনীর দুলালের মতো বড় না করে আদর্শ শিক্ষিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। এই উদ্দেশ্যেই মফিজ তালুকদার ফণী স্যারকে অনুরোধ করেছিলেন, তার ছেলেদের একটু বিশেষ যতœ নিয়ে শিক্ষাদান করার জন্য। ফণী স্যার মফিজ তালুকদারের অনুরোধ রেখেছিলেন এবং তিনি ও তার পরিবারও স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন যথার্থভাবেই। ফণী স্যারের পরিবার দেশ ছেড়ে যাবার পর থেকে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তিনি মফিজ তালুকদারের বাড়িতেই সসম্মানে এবং সাচ্ছন্দ্যে কাটিয়েছেন। স্যারের সেবা-শুশ্রুষার যেন কোনরকম ত্রুটি না হয়, তা শতভাগ নিশ্চিত করেছেন মফিজ তালুকদার নিজে এবং তার অবর্তমানে তার সহধর্মিণী এবং সন্তানরা। সিরাজগঞ্জের বিশাল বাড়িব দুটি কক্ষ বরাদ্দ ছিল স্যারের থাকার জন্য। একাধিক লোক সার্বক্ষণিক দেখাশোনার কাজে নিয়োজিত ছিল। প্রতিবারের খাবার তৈরি হতো স্যারের নিজের পছন্দ অনুযায়ী। নিয়মিত ডাক্তার দেখানোসহ স্বাস্থ্যসেবাও নিশ্চিত করা হয়েছে যথাযথভাবে। এরকম যতœ ও সেবার কারণেই স্যার ৯৬ বছর পর্যন্ত সুস্থ ছিলেন এবং কোন দুরারোগ্য ব্যাধিতে না ভুগে বা দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী না থেকে স্বজ্ঞানে বিদায় নিতে পেরেছেন। ফণী স্যার তার সুযোগ্য ছাত্রদের কাছ থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত যে সম্মান ও সেবা পেয়েছেন, তা অনেকেই নিজের ছেলেমেয়েদের কাছ থেকেও পায় না। এটিই একজন শিক্ষকের জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি।

মফিজ তালুকদার নিজে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ ছিলেন এবং শিক্ষককে গুরু হিসেবে মনে করতেন এবং গুরুর মতই শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতেন। তিনি তার এই আদর্শ তার সন্তানদের মাঝেও ধারণ করাতে সক্ষম হয়েছেন। এ কারণে মফিজ তালুকদারের অবর্তমানে তার ছেলেরাও ফণী স্যারের যতœ নিতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য বা বিচ্যুতি করেননি। ফণী স্যার মারা যাবার সংবাদ পেয়ে মফিজ তালুকদারের ছেলে ঢাকা থেকে ছুটে আসেন সিরাজগঞ্জে স্যারের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য এবং তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠান ধর্মীয় বিধান মতে সম্পন্ন করার জন্য। তারা এও জানতেন যে, হিন্দু ধর্মের রীতি অনুসারে ছেলেরাই মৃত পিতামাতার মুখাগ্নি করে থাকেন। সেই বিবেচনা থেকেই তারা কলকাতা থেকে স্যারের ছেলেকে আনার চেষ্টাও করেছিলেন বলেই জেনেছি। কিন্তু সফল হতে পারেননি। তাতে কি? গুণী শিক্ষকের মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য মানুষের সমাগম হয় তার সৎকার করার জন্য। সিরাজগঞ্জের শ্মশানঘাট লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। হিন্দু-মুসলমান সকল সম্প্রদায়ের অসংখ্য মানুষের উপস্থিতিতেই ফণী স্যারের মাতৃভূমি সিরাজগঞ্জের শ্মশানেই সম্পন্ন হয় তার শেষকৃত্য। তার শ্রাদ্ধশান্তিও ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী যথাযথভাবে সম্পন্ন করার যাবতীয় ব্যায়ভার স্যারের সেই যোগ্য ছাত্ররাই বহন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ধন্য ফণী স্যারের জীবন, ধন্য স্যারের যোগ্য ছাত্র ও প্রয়াত মফিজ তালুকদারের সন্তানরা। এটিই বাংলাদেশের প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক চেতনা, যা ভবিষ্যতেও অটুট থাকবে এবং আর কোন কালো থাবায় বিঘ্নিত হবে না কোন দিন। তাহলেই শান্তি পাবে ফণী স্যারের আত্মা এবং প্রয়াত মফিজ তালুকদারের আত্মা।

লেখক : ব্যাংকার, টরেনটো, কানাডা

[email protected]

সূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ