• বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৮ ১৪৩১

  • || ২২ শাওয়াল ১৪৪৫

সাহাবা সমাজের বৈশিষ্ট্য ও আমাদের সমাজ

নীলফামারি বার্তা

প্রকাশিত: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮  

জরত মুহাম্মাদ (সা.) চল্লিশ বছর বয়সে উপনীত হলে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ্য হতে নবুয়ত লাভ করেন। নবুয়ত পেয়ে তিনি তাওহীদের আওয়াজ তুলেন।

তখন আসমানী নূরের আলো কোথাও নিভু নিভু করে জ্বললেও আরবসহ সকল দুনিয়া ছিলো অন্ধকারাচ্ছন্ন। বিশেষ করে মক্কাবাসীরা বাপ-দাদাদের থেকে প্রাপ্ত মূর্তিপূজায় লিপ্ত ছিলো। তাই একত্ববাদের দাওয়াত তাদের কাছে একেবারেই অপরিচিত ছিলো; তাদের ধর্মই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল।

বাপ-দাদার ধর্মে আঘাতের কারণে সকলেই মুহাম্মাদ (সা.) এর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠলো। অন্যদিকে অনেকে রাসূল (সা.) এর দাওয়াতে সাড়া দিয়ে মুসলমান হয়েছিল। মক্কার মুশরিকদের বিরোধিতায় তাদের জীবন যাত্রা সব দিক থেকে সংকুচিত হয়ে আসতে লাগলো। কিন্তু এত সব বাধা-বিপত্তি সত্তেও মুসলমানের পাল্লা দিন দিন ভারী হতে থাকে। দলে দলে মানুষ তাওহীদের ছায়ায় আশ্রয় নেয় এবং সর্বশেষ মদীনায় একটি আদর্শ ইসলামী সমাজ গড়ে উঠে।

মদীনার সমাজ ছিলো একটি আদর্শ সমাজ। এই সমাজের সদস্য ছিলেন সাহাবায়ে কেরাম (রা.)। মদীনার সেই আদর্শ সমাজের অসংখ্য বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য ছিলো, যা দেখে বিশ্ববাসী ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ছিলো; এমনকি ইন্দোনেশিয়া থেকে মরোক্কো ও সুদূর ইউরোপের বহু দেশ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছিলো। চীনের মতো দূর প্রাচ্যেও ইসলামের প্রচার প্রসার ঘটেছিলো সেই প্রভাবের কারণেই।

তারপর আসলো অধঃপতনের যুগ। মুসলমানরা নিজেদের দায়িত্ব ভুলে আরাম-আয়েশ ও বিলাসী জীবন যাপনে মত্ত হলো। নিজেরা গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হলো ক্ষমতার লিপ্সায়। একটি ইসলামী আদর্শ সমাজে যে সকল গুণাগুণ ও বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার, তা মুসলিম সমাজ থেকে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে থাকে। বর্তমানে মুসলমানদের অবস্থা দাঁড়ালো এই, সর্বক্ষেত্রে চারিত্রিক অধঃপতন মহামারি রূপ ধারণ করেছে। বিভিন্ন ধরনের ফেতনা ও ভ্রান্ত ধ্যান-ধারনার লালন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে মুসলিমবিশ্ব।

পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতার খাঁটি অনুসারী বনেছে আজকের মুসলমান। সর্বত্র নির্লজ্জ ও বেহায়াপনা ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাপকভাবে। হিংসা-বিদ্বেষ, অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ আজ মুসলিম সমাজের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এ জন্যে বিশ্বের অন্যান্য জাতি গোষ্ঠি মনে করে, মুসলমান মানে নিম্ন শ্রেণীর মানুষ। মুসলিম প্রাচ্য মানে ময়লা, দুগর্ন্ধে ভরা শহর নগর। মুসলমানদের প্রভাব কমে এসেছে বিশ্ববাসীর ওপর। এখন অমুসলিমরা তাদের দেখে প্রভাবিত হওয়ার স্থলে হতাশ হয়। অথচ সাধারণ একজন মুসলমানের আমলও একসময় এমন রেখাপাত করতো যে, সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ইমান নিয়ে আসতো। কিন্তু এখন মুসলমানের আমলের এত অবনতি যে, বড় বড় ব্যক্তিদের আমল দেখেও ইসলাম ও মুসলমান সম্পর্কে খারাপ ধারনা তৈরি হয়।

একটি ইসলামি সমাজ, অন্য একটা সমাজে কখন প্রভাব ফেলতে পারে? এই প্রশ্ন ও তার উত্তর পূর্বের আলোচনায় এসে পড়েছে। অর্থাৎ যখন কোনো মুসলিম সমাজ, ইসলামের সোনালী যুগের বৈশিষ্ট্যগুলো ধারন করবে, এ সকল গুণাগুণ শূন্য হওয়াকে নিজেদের ধ্বংসের কারণ মনে করবে তখনই অন্য একটি সমাজ তাদের দ্বারা প্রভাবিত হবে। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) কোরআনে বর্ণীত কোনো গুণের বিপরীত নিজেদের অবস্থা দেখলে মনে করতেন, আল্লাহ তায়ালা নাখোশ হয়ে হয়তো সবকিছু দুনিয়ার জীবনেই দিয়ে দিচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের আমলের পর্যালোচনা করতেন। হায়! আমরা আজ কোথায়!

মদীনায় সাহাবাদের সমাজের সকল বৈশিষ্ট্য আলোচনায় আনা কঠিন। তারপরও উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিম্নে আলোচনা করা হলো-

এক. সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে সুদৃঢ় অবস্থান ও অবিচলতা:

আমাদের অনেকে কোনো বিষয়কে ন্যায় হিসেবে মেনে নিয়েও চাপের কারণে, তার পক্ষালম্বন করে, এর ওপর অবিচল থাকতে পারে না। অনেকে সত্যের পথ থেকে হটে যায় লোভে বশিভূত হয়েও। এ জন্যে অন্যকেউ আমাদের অনুসরণ করতে গিয়ে হোঁচট খায়। কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম (রা.) ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তারা হক বিশ্বাস করার পর, আমৃত্যু এর ওপর অটল অবিচল থাকতেন। বাধার প্রাচীর, প্রতিকূল আবহাওয়া, বিভিন্ন রকমের বিপদ-আপদ দেখে কখনো ন্যায়ের পথ থেকে বিচ্যুত হতেন না। দুশমনের হুমকি ধমকি বা লোভ লালসার ফাঁদে কখনো তারা পা দিতেন না। তারা ছিলেন ‘এবং আপনি অবিচল থাকুন, যেরূপ আপনাকে আদেশ করা হয়েছে এবং ওদের খেয়াল খুশির অনুসরণ করবেন না’ এই আয়াতের প্রতিচ্ছবি।

দুই. নিঃস্বার্থ কুরবানী ও অন্যকে অগ্রাধিকার দান:

সামাজিক জীবনে প্রভাব ফেলা, দাওয়াতের ময়দানে সফল হওয়ার কার্যকর হাতিয়ার হচ্ছে নিঃস্বার্থ কোরবানী ও অন্যকে অগ্রাধিকার দান। এ বিষয়ে নববী যুগের মদীনার সমাজ সকলের আদর্শ। মহান আল্লাহ তায়ালা এ ময়দানে তাঁদের সক্ষমতার স্বীকৃতি দিয়েছেন, ‘তাঁরা নিজেদের ওপর অন্যদের অগ্রাধিকার দেন, যদিও স্ব স্ব অবস্থানে তাঁরা (ওই বিষয়ের) মুখাপেক্ষী।’ এ-অগ্রাধিকার দান কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে সীমাবদ্ধ ছিলো না। ধন সম্পদের বেলায় অন্যকে অগ্রাধিকার দেয়ার অসংখ্য ঘটনা সাহাবা চরিতে রয়েছে। একজন মানুষের অমূল্য সম্পদ তার জীবন। সেখানেও সাহাবায়ে কেরাম (রা.) অন্যকে অগ্রাধিকার দিতেন।

অথচ আজকে মুসলমানের প্রবাদ হচ্ছে, ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম’। হিজরতের সময় নবী করীম (সা.) এর বিচানায় হজরত আলী (রা.) শুয়ে শিক্ষা দিয়ে গেছেন, কীভাবে অন্যের জীবনকে অগ্রাধিকার দিতে হয়। আরেকটি ঘটনা, যা আসমান জমিন একদিনই প্রত্যক্ষ করেছে, এর আগেও দেখেনি, পরেও দেখবে না। ‘ইয়ারমুকের যুদ্ধে একজন আহতের জীবন যখন ওষ্ঠাগত, পানি পানি বলে আত্মচিৎকার করছিলো তখন একলোক ওই আহতের মুখে পানি তুলে ধরলেন; পাশ থেকে আওয়াজ আসলো ‘পানি পানি’, ওই আহত লোকটি নিজে মুমূর্ষ অবস্থায় থেকেও নির্দেশ দিলেন, তাকে পানি পান করাও, আমার চেয়ে তার পিপাসা বেশি।’ যুদ্ধের ময়দান, রাসুলের নিরাপত্তা, দীনের হেফাজত ও জাতীয় প্রয়োজন, এমন প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) এর নিঃস্বার্থ কোরবানী ও আত্মত্যাগের রেকর্ড এখনো আমাদের মাঝে বিদ্যমান। এগুলো দ্বারা অমুসলিমরা কতটুকু প্রভাবিত হতো এবং কীভাবে ইসলামের ছায়ায় এসে আশ্রয় নিতো তাও আমাদের সামনে রয়েছে। কিন্তু আমরা কী পেরেছি তা থেকে কিছু নিতে?

তিন. সমবেদনা ও পরোপকার:

সর্বোত্তম মানুষ সে, যে অন্যের উপকার করে। খাঁটি মুসলমান সে, যার জবান ও হাত থেকে অপর মুসলমান হেফাজত থাকে। প্রকৃত মুমিন ওই ব্যক্তি, যার অনিষ্টতা থেকে মানুষের জান ও মাল নিরাপদ থাকে। যে ব্যক্তি আল্লাহর সৃষ্টির সঙ্গে ভালো আচরণ করবে সে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হয়ে যাবে। এগুলো একটি ইসলামী সমাজের বুনিয়াদ। রাসূল (সা.) যুগে মদীনার সমাজ এই ভিত্তির ওপরই দাঁড়িয়ে ছিলো। এই আন্দাজের ওপর প্রত্যেক মুসলমান নিজেদের জীবন পার করতো। কবির ভাষায়-

আমার জবান ও কলম দ্বারা কেউ যেন ব্যথা না পায়

আসমানের নিচে আমার ব্যাপারে কারো যেনো অভিযোগ না থাকে

 

হজরত জাবির (রা.)। প্রথম সাক্ষাতেই রাসূল (সা.) তাকে উপদেশ দিলেন, কাউকে গালি দিও না। তিনি বলেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি কোনো স্বাধীন বা গোলামকে গালি দেইনি। মানুষ তো দূরের কথা, কোনো পশুকেও আমি গালিগালাজ করিনি।’ অন্যের দুখ-কষ্টকে নিজের মনে করা নয় বরং নিজেরটার চেয়ে অন্যেরটার উপলব্ধি বেশি থাকা, এই ছিলো সাহাবায়ে কেরামের সিফাত।

চার. ন্যায় ও সমতা:

আল কোরআনের সমাজ ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক ব্যবস্থা। জুলুম ও অবিচারকে ইসলাম কখনো প্রশ্রয় দেয়নি বরং এগুলোকে বিশ্ব শান্তি ও মানব সভ্যতার অস্তিত্যের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি মনে করে। প্রত্যেকজন সাহাবী ইনসাফ ও সমতার প্রত্যাশী ছিলেন। নিজের বিষয়ে বা আত্মীয়-স্বজনের ব্যাপারেও তারা অন্যায় সিদ্ধান্ত কামনা করতেন না। একবার গ্রাম্য এক সাধারণ মুসলমানের পা গাস্সানী সরদার জাবালার কোমরে লেগে যায়। ওই সরদার মুসলমান হয়েছিলো। এতে সে ক্ষিপ্ত হয়ে খুব জোড়ে ওই গ্রাম্য লোককে আঘাত করলে, তার নাকের বাঁশি ছিদ্র হয়ে গেলো। হজরত ওমর (রা.) এর নিকট এই মামলা দায়ের হলো। তিনি শুনে ওই সরদারকে পরামর্শ দিলেন, হয় তাকে কোনভাবে রাজী করাও অন্যথায় কিসাসের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ কর। জাবাল বললো রায়টা একটু হালকা দেয়া যায় না? হজরত ওমর (রা.) বললেন, ইসলামে আমীর আর ফকিরের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। ইসলাম সাম্যের ব্যবস্থা, এখানে বৈষম্যের কোনো সুযোগ নেই। এ কথা শুনে জাবালা সময় নেয়ার ভান করে পালিয়ে গিয়ে পুনরায় খৃস্ট ধর্ম গ্রহণ করে। কিন্তু হজরত ওমর (রা.) সুবিচার থেকে সামান্য এদিক সেদিক হননি।

পাঁচ. সামাজিকতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ:

পরস্পর ভালোবাসা ও বন্ধুতপূর্ণ সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরাম অনন্য। দীর্ঘদিন আওস ও খাজরাজ গোত্র লড়াইরত ছিলো। ইসলামের গ্রহণের পর তারা সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় হয়ে গেলো। মুনাফিক ও ইহুদীরা শত চেষ্টা করেও তাদের মাঝে কোনো ফাটল ধরাতে পারে নাই। মতানৈক্যপূর্ণ বিষয়ে হাওয়া দেয়া, গুজবে কান দেয়া ও পরস্পর খারাপ ধারণা থেকে সাহাবায়ে কেরামের ছিলেন সম্পূর্ণ মুক্ত। এ জন্যে তাদের একতা ছিলো অন্যদের জন্য অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত।

ছয়. কথা ও কাজে মিল:

মানুষের কথা ও কাজে মিল না থাকা একটা সমাজ ধ্বংসের জন্য যথেষ্ঠ। মহান আল্লাহ তায়ালার কাছেও উহা অত্যন্ত অপছন্দনীয়। সমাজ সংশোধনের বুনিয়াদ হলো, সমাজের প্রত্যেক জন সদস্য আদর্শ দিয়ে অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত কায়েম করবে; ‘গুফতার কা গাজী’ শুধু কথায় পটু হবে না। হজরত ওসমান (রা.) রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিয়ে জাতির উদ্দেশ্যে এ-কথাই বলেছিলেন। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) এর কথা ও কাজে মিল থাকার কারণে অসংখ্য মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছিলো।

সাত. পবিত্রতা:

ইসলামের চাওয়া হলো মুসলমান সকল দিক থেকে পাক-পবিত্র থাকবে। তাই সাহাবায়ে কেরামের সমাজ মাথা থেকে পা পর্যন্ত পবিত্র ছিলো। সমস্ত ভ্রান্ত চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারনা ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও তারা ছিলেন পাক পবিত্র। তাদের দৃষ্টি, খাবার-দাবার ও পোশাক-আশাক হতো পাক। নির্লজ্জ ও জুলুম অত্যাচার থেকে সমাজ ছিলো পাক। তাদের রাজনীতি ধোকা প্রতারনা থেকে পবিত্র। অর্থাৎ সাহাবাদের সমাজ সকল দিক থেকে পাক ছিলো। কিন্তু আমরা ওজুর পবিত্রতা ছাড়া বাকী কোনো পাক পবিত্রতাই বুঝি না; ভ্রান্ত চিন্ত-চেতনা, ধ্যান-ধারনা ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পবিত্র থাকা ‘বহুত দূর কা বাত হ্যায়।’

আট. মানুষের অধিকার আদায়:

একজন মানুষের ওপর আল্লাহ তায়ালা ও অন্য বান্দাদের হক আছে। বান্দার হক আল্লাহর হকের তুলনায় গুরুত্বপূর্ণ। সাহাবায়ে কেরাম এ ময়দানে ছিলেন সবচেয়ে উত্তমভাবে হক আদায়কারী। মদীনার সমাজের অসংখ্য বৈশিষ্ট্য থেকে এই কয়েকটা এখানে আলোচনা হলো। একটা সমাজ অন্য একটা সমাজকে আকৃষ্ট করতে চাইলে এই বৈশিষ্ট্যগুলো ধারণ করার কোনো বিকল্প নেই।

মাওলানা আসজাদ কাসেমী নদবী শাহীর কলাম থেকে অনূদিত