• শুক্রবার ০৩ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২০ ১৪৩১

  • || ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫

হত্যা-গণহত্যা, লুটপাট-অগ্নিসংযোগে তৎপর ছিলেন সাঈদী

– নীলফামারি বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৩ মে ২০২০  

দেইল্লা রাজাকার ওরফে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী পিরোজপুর জেলার তৎকালীন ইন্দুরকানীর (বর্তমানে জিয়ানগর উপজেলা) সাউথখালী গ্রামে ১৯৪০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম ইউসুফ আলী শিকদার। তার প্রকৃত নাম দেলোয়ার হোসেন শিকদার। তাকে ‘দেইল্লা’ নামে সকলে চিনতেন। ১৯৭১ সালের ৪ মে সকাল বেলা পিস কমিটির মেম্বার হিসাবে দেইল্লা ওরফে সাঈদীর নেতৃত্বে মধ্য মাছিমপুর বাসস্ট্যান্ডের পেছনে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য জমায়েত হওয়া ২০ জন বেসামরিক ব্যাক্তিকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়।

একই সময়ে মাছিমপুর হিন্দুপাড়ায় প্রকাশ্য দিবালোকে পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তায় লুটপাট করে তাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেন এবং পলায়নরত অজ্ঞাত সংখ্যক ব্যক্তিদের মধ্য থেকে পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে শরত চন্দ্র মন্ডল, বিজয় মিস্ত্রি, উপেন্দ্রনাথ, জগেন্দ্রনাথ মিস্ত্রি, সুরেন্দ্রনাথ মিস্ত্রি, মতিলাল মিস্ত্রি, জগেশ্বর মণ্ডল, সুরেশ মণ্ডলসহ অজ্ঞাতনামা ৫ জনসহ আরও ১৩ জনকে হত্যা করেন সাঈদী ও তার সহযোগীরা। এরপর সাঈদী নেতৃত্ব দিয়ে এলজিইডির পেছনে ধোপা বাড়ির নিকটস্থ হিন্দুপাড়ায় ঢুকে দেবেন্দ্রনাথ মণ্ডল, জগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, পুলিন বিহারী ও মুকুন্দ বালাকেও গুলি করে হত্যা করেন।

এর পর তারা কালিবাড়ি, মাছিমপুর, পালপাড়া, শিকারপুর, রাজারহাট, কুকারপাড়া, ডুমুরতলা, কদমতলা, নবাবপুর, আলমকুঠি, ঢুকিগাতি, পারেরহাট এবং চিংড়াখালী গ্রামে ধর্মীয় কারণে বেসামরিক জনগোষ্ঠির বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে।

এছাড়া সাঈদীর পরামর্শ, পরিকল্পনা এবং প্রণীত তালিকা অনুযায়ী এলাকার বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রদের পাইকারি হারে নিধন করা হয়।

সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মিজানুর রহমান, স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুল গাফফার মিয়া, সমাজসেবী শামসুল হক ফরাজী, অতুল কর্মকার প্রমুখ সরকারি কর্মকর্তা ও বুদ্ধিজীবীদেরও সাঈদীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। সাঈদী এবং তার সহযোগীরা পিরোজপুরের মেধাবী ছাত্র গণপতি হালদার, তদানীন্তন ইপিআর সুবেদার আব্দুল আজিজ এবং পারেরহাট বন্দরের কৃষ্ণকান্ত সাহা, বাণীকান্ত সিকদার ও তরণীকান্ত সিকদারসহ আরো অনেক ব্যবসায়ীকেও ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছেন।

৭ মে পাকিস্তান আর্মিরা পারেরহাটে এলে সাঈদী শান্তি কমিটির সদস্য হিসেবে তাদের স্বাগত জানান। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে পারেরহাটের আওয়ামী লীগ নেতা ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘরে প্রবেশ করে তিনি মাখন লাল সাহার দোকান থেকে ২২ সের সোনা ও রুপা লুট করে নেন।

৮ মে বেলা দেড়টার দিকে আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল ইসলাম খান সেলিমের পুত্র শহিদুল ইসলামের বাড়িতে প্রবেশ করে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেন সাঈদীরা। এরপর দুপুর ৩টার দিকে তারা মানিক পশারীর বাড়িতে প্রবেশ করেন এবং সেখান থেকে মফিজ উদ্দিন ও ইব্রাহিম কুট্টিকে আটক করে নিয়ে আসেন। এর পর মানিক পশারীর বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। আটককৃত মফিজ উদ্দিন ও ইব্রাহিম কুট্টিকে নিয়ে এসে পাড়েরহাট বন্দরে ইব্রাহিম কুট্টিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আর মফিজউদ্দিনকে রাজলক্ষী হাইস্কুলের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনের এক পর্যায়ে সে পালিয়ে আসেন মফিজ উদ্দিন।

২ জুন সকাল ৯টায় সাঈদীর নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনারা নলবুনিয়ায় আবদুল হালিম বাবুলের বাড়ি থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র লুট ও অগ্নিসংযোগ করে। এরপর তারা উমেদপুর হিন্দুপাড়ায় প্রবেশ করে ২৫টি বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়ে বিশা বালীকে গুলি করে হত্যা করে।

২ জুন পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে টেংরাখালী গ্রামের মাহবুবুল আলম হাওলাদারের বাড়িতে যান সাঈদী। তারা মাহবুবের ভাই আব্দুল মজিদ হাওলাদারকে আটক ও নির্যাতন এবং বাড়িতে স্বর্ণালঙ্কারসহ নগদ টাকা লুট ও ভাঙচুর করে।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার ২/৩ মাস পরে একদিন পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে নলবুনিয়া গ্রামের আজহার আলীর বাড়িতে যান সাঈদী। সেখানে আজহার আলী ও তার ছেলে সাহেব আলীকে নির্যাতনের পর সাহেব আলীকে পিরোজপুরে পাঠান। সেখানে সাহেব আলীকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে সাঈদী মুক্তিযোদ্ধা মিজান তালুকদারের বাড়িতে হামলা চালান। তারা মিজানের বড়ো ভাই আব্দুল মান্নান তালুকদারকে ধরে পারেরহাটে পিস কমিটির অফিসে নিয়ে যান। সেখানে তার ওপর সাঈদী পাশবিক নির্যাতন চালান এবং তার ভাই মুক্তিযোদ্ধা মিজান তালুকদার কোথায় আছে জানতে চান ও তার সন্ধান দিতে বলেন।

মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে ১৫-২০ জনের রাজাকার দল হোগলাবুনিয়া গ্রামের ১৪ জন হিন্দু নাগরিককে ধরে। পাকিস্তানি সেনারা তাদের সবাইকে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়। সাঈদীর সহযোগিতায় পিরোজপুরের হিমাংশু সাহার ভাই ও আত্মীয়-স্বজনকে হত্যা করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষ।

নভেম্বরের শেষ দিকে সাঈদী খবর পান, সাধারণ মানুষ ভারতে পালিয়ে যাচ্ছে। তার নেতৃত্বে ১০-১২ জনের একটি সশস্ত্র দল পরিকল্পিতভাবে ইন্দুরকানি গ্রামের তালুকদার বাড়িতে আক্রমণ চালায়। ৮৫ জন ব্যক্তিকে আটক করে তাদের কাছ থেকে মালামাল কেড়ে নেওয়া হয়। ১০-১২ জন বাদ দিয়ে বাকিদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় সাঈদী তার এলাকায় অপর চারজন সহযোগী নিয়ে ‘পাঁচ তহবিল’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন, যাদের প্রধান কাজ ছিল মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী বাঙালি হিন্দুদের বাড়িঘর জোরপূর্বক দখল করা এবং তাদের সম্পত্তি লুট করা। লুট করা এ সমস্ত সম্পদকে সাঈদী ‘গনিমতের মাল’ আখ্যায়িত করে নিজে ভোগ করতেন এবং পারেরহাট বন্দরে এসব বিক্রি করে ব্যবসা পরিচালনা করতেন।

তিনি ধর্মের দোহাই দিয়ে পারেরহাট বন্দরের হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি লুট করেছেন ও নিজে মাথায় বহন করেছেন এবং মদন নামে এক হিন্দু ব্যবসায়ীর বাজারের দোকানঘর ভেঙে তার নিজ বাড়িতে নিয়ে গেছেন।

বাজারের বিভিন্ন মনোহরি ও মুদি দোকান লুট করে লঞ্চঘাটে দোকানও দিয়েছিলেন সাঈদী। সাঈদী এবং তার সহযোগীরা পিরোজপুরের নিখিল পালের বাড়ি তুলে এনে পারেরহাট জামে মসজিদের ‘গণিমতের মাল’ হিসেবে ব্যবহার করেন। মদন সাহার বাড়ি উঠিয়ে নিয়ে সাঈদী তার শ্বশুরবাড়িতে স্থাপন করেন। পারেরহাটের আনোয়ার হোসেন, আবু মিয়া, নূরুল ইসলাম খান, বেনীমাধব সাহা, বিপদ সাহা প্রমুখের বসতবাড়ি, গদিঘর ও সম্পত্তিও এই সাঈদী লুট করে নেন।

প্রসঙ্গত, যুদ্ধাপরাধের দায়ে ২০১৩ সালের  ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১৷ আপিলে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়৷ পরে সাঈদীর খালাস চেয়ে রিভিউ আবেদন দায়ের করেন তার আইনজীবী৷ তারপর রাষ্ট্রপক্ষ তার শাস্তি বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডের আবেদন করে৷ আর রিভিউয়ের রায়ে সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড নয়, আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়৷