• সোমবার ২০ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৫ ১৪৩১

  • || ১১ জ্বিলকদ ১৪৪৫

প্রসাধনীর শুরুটা যেভাবে

নীলফামারি বার্তা

প্রকাশিত: ২৩ নভেম্বর ২০১৮  

সুদৃশ্য জারে মিসরীয়রা তাদের প্রসাধনী সংরক্ষণ করত। বিভিন্ন সমাধিস্থল থেকে এ ধরণের অনেক জার আবিষ্কার করেছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। ফলে তাদের ব্যবহৃত প্রসাধনীর পরিমাণ ও প্রকৃতি সম্পর্কেও এখন ধারণা করা সম্ভব হচ্ছে। নাক, চোখ, মুখমণ্ডল এমনকি হাত পায়ে মালিশ করার উপযোগী ক্রিম তৈরিতে হাতির দাঁত, শামুকের খোল চূর্ণ, নানা ফলের বীজ ও তেল ব্যবহৃত হয়েছে এমন প্রমাণ মিলেছে। এদিকে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে মিসরের সুগন্ধী বিখ্যাত ছিলো তার অনিন্দ্যসুন্দর সুবাসের দীর্ঘস্থায়ীত্বের জন্য।গোলাপ থেকে শুরু করে নানা ধরণের স্থলজ ও জলজ ফুল থেকে এই সুগন্ধী নিষ্কাশন করত তারা।

 

1.প্রসাধনীর শুরুটা যেভাবে (শেষ পর্ব)

পাশাপাশি এর দীর্ঘস্থায়ী সংরক্ষণে তারা ফার্মেন্টেশনের মত নানা উপযুক্ত পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলো।এক্ষেত্রে হেনা, দারুচিনি, তার্পিন, আইরিশ, লিলি, গোলাপ প্রভৃতি ফুলের পাশাপাশি কিছু ফলের বিচিকে পানি বা তেলে দ্রবীভূত করে সেখান থেকে যেমন সুগন্ধী নিষ্কাশন করতে দেখা গেছে। তেমনি তারা এসব উপকরণকে জ্বাল দেয়ার পর সেখান থেকে নানা ধরণের তরল সুগন্ধী বের করে এনেছে। তবে তারা যে ক্রিমগুলো তৈরি করেছে সেখানে নানা ধরণের উপাদান চূর্ণ করে তেল বা চর্বি দিয়ে সেগুলোর পেস্ট বানানো হত। এ ধরণের ক্রিম, পারফিউম কিংবা পাউডার জাতীয় প্রসাধনী তৈরি করতে অনেক ক্ষেত্রে প্রায় ২০ টি উপাদানও লেগে যেত।

 

2.প্রসাধনীর শুরুটা যেভাবে (শেষ পর্ব)

গ্রীসে মেয়েরা শরীরে রং এর প্রলেপ ব্যবহার করতো।ভূমধ্যসাগরীয় এক ধরণের লতা-গুল্ম থেকে অ্যালকানেট নামে লাল রং বের করে তারা গালে লাগাতো। আর মুখ এবং শরীর উজ্জ্বল দেখানোর জন্য সাদা রং ব্যবহার করতো। বোঝাই যাচ্ছে এগুলো থেকেই এসেছে বর্তমান রুজ ও ফেস পাউডারের প্রচলন। পাঁচ হাজার বছর আগেও সৌন্দর্য সচেতন ক্লিওপেট্রার দেশের মানুষেরা প্রসাধন হিসেবে একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান ব্যবহার করতো, আর তা হচ্ছে স্বর্ণ। ত্বকের সুরক্ষায় তৈরি তাদের বিভিন্ন পণ্যের মাঝে স্বর্ণের উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। এমনকি ত্বকের ঔজ্জ্বল্য ধরে রাখার পাশাপাশি চামড়ার রঙ সূর্য বর্ণ রাখার জন্য রাতের বেলা ক্লিওপেট্রা স্বর্ণের মুখোশ পরে ঘুমাতেন।

 

3.প্রসাধনীর শুরুটা যেভাবে (শেষ পর্ব)

বর্তমানের বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে আবিষ্কার করেছেন যে সোনা, মুক্তা ও হীরায় রয়েছে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট যা বয়সের ছাপ কমিয়ে আনে ও মুখের বলিরেখা দূর করে। বলা যায়, ক্লিওপেট্রার অনুসারী হয়েই বর্তমানে হীরার সংমিশ্রণে তৈরি সাবান দিয়ে স্নান করেন মার্কিন কণ্ঠশিল্পী ও অভিনেত্রী জেনিফার লোপেজ। শুধু মিশরই নয়, প্রাচীন চীন এবং গ্রিসেও ত্বককে সতেজ এবং স্বাস্থ্যকর রাখতে স্বর্ণের প্রলেপ লাগানোর চল ছিল। এখন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রসাধন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্যে ব্যাপকহারে এটি ব্যবহার করছে। ফেস মাস্ক, শ্যাম্পু, ক্লিনজার, ময়েশ্চারাইজার, অ্যান্টি এজিং ক্রিম এবং স্ক্র্যাবের মতো হাজারো পণ্যে অহরহ খাঁটি স্বর্ণ মেশানো হচ্ছে। তবে সেটা অবশ্যই বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর।

 

4.প্রসাধনীর শুরুটা যেভাবে (শেষ পর্ব)

প্রসাধনীর ব্যবহার বা রূপচর্চার ইতিহাস বলতে গেলে অগ্রপথিক হিসেবে ৪ নারীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য - মিশরের ক্লিওপেট্রা, বাইজানটিয়ার থিওডোরা, ফ্রান্সের মাদাম পঁপিদু এবং ভারতের সম্রাজ্ঞী নূর জাহান। ক্লিওপেট্রা প্রসাধন শিল্পকে পুরোহিতদের হাত থেকে ছিনিয়ে এনে অর্থাৎ ধর্ম থেকে সরিয়ে এনে একে চিকিৎসা বিদ্যার সাথে সংযোজন করেন। বর্তমানের বহুল প্রচলিত ফেস মাস্ক এর প্রবর্তক রাণী ক্লিওপেট্রা। পরাক্রমশালী ফারাওদের সময় থেকেই প্রসাধনের ওপর পুরোহিতদের আধিপত্য কমতে শুরু করেছিলো।

 

5.প্রসাধনীর শুরুটা যেভাবে (শেষ পর্ব)

ষষ্ঠ শতাব্দীতে বাইজেনটাইন সভ্যতার প্রাক্কালে কনস্ট্যানটিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) শহরটির পত্তনের পর সেখানে রাজত্ব করতেন খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী রাজা জাসটিনিয়ন। তারই রানী থিওডোরা প্রসাধনকে এক নতুন ধাপে নিয়ে যান। তিনি বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিতে প্রসাধনের গবেষণা শুরু করেন। অসামান্য রূপের অধিকারিণী ছিলেন কনস্ট্যানটিনোপল শহরের হিপোড্রোমের সামান্য এক ভাল্লুক পালকের এই কন্যা। অতি সাধারণ পরিবারে জন্ম হলেও নারী হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মহিয়সী আর প্রসাধন তৈরিতে ছিলেন অসাধারণ জ্ঞানী। নানা রকম গাছ-গাছড়া নিয়ে তিনি নতুন নতুন প্রসাধন সামগ্রী তৈরি করতেন তার নিজের গবেষণাগারে।

 

6.প্রসাধনীর শুরুটা যেভাবে (শেষ পর্ব)

এ বিষয়ে রাজ চিকিৎসক ইতওস ছিলেন তার সুযোগ্য সহকারী। এছাড়া তিনি ছিলেন তার সময়ে প্রসাধন শিল্পের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। একাদশ শতাব্দীতে কনস্ট্যানটিনোপলের সিংহাসনে এক সম্রাজ্ঞীর অধিষ্ঠান হয় মাদাম পঁপিদু জোই নামে। তিনি জানতেন যৌবনকে কীভাবে ধরে রাখতে হয়। সত্যি সত্যিই তাকে বলা হতো অনন্ত যৌবনা। তিনি পঞ্চাশ বছর বয়সে বাইজানটাইন সিংহাসনে তার খুল্লতাত অষ্টম কনস্ট্যানটিনোপল এর স্থলাভিষিক্ত হন। এই অনন্ত যৌবনা নারী নিজের আবিষ্কৃত প্রসাধন প্রণালী দিয়ে বার্ধক্যকে দূরে রেখেছিলেন।

 

7.প্রসাধনীর শুরুটা যেভাবে (শেষ পর্ব)

জানা যায়, বাহাত্তর বছর বয়সে যখন তিনি মৃত্যুবরণ করেন তখনো তার মুখ দেখাচ্ছিল ষোল বছরের তরুণীর মত। মোঘলরা প্রসাধন চর্চায় এনেছিলো নতুন উদ্যম। জাতি হিসেবে মোঘলরা ছিলো জাঁকজমকপ্রিয় এবং প্রসাধন বিলাসী।মোঘল সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের গুণের চর্চা ছিলো সারা সম্রাজ্য জুড়ে।তিনি সাহিত্য চর্চা করতেন, কবিতা লিখতেন, চিত্র শিল্পেও তার অসাধারণ দক্ষতা ছিলো।আর তার বিশেষ পরিচিতি ছিল সুরুচি সম্পন্ন সাজগোজ অর্থাৎ প্রসাধন ব্যবহারের জন্য। তিনি বিভিন্ন প্রসাধন সামগ্রীও তৈরি করতে পারতেন। বিশেষ করে সুগন্ধিদ্রব্য প্রস্তুত করতেন। বিভিন্ন ফুল থেকে নির্যাস নিয়ে তাদের সংমিশ্রণে নতুন নতুন সুগন্ধি তৈরি করা ছিলো তার শখ।

 

8.প্রসাধনীর শুরুটা যেভাবে (শেষ পর্ব)

গাই-দ্য-শৌলক (১৩০০-১৩৬৮ খৃস্টাব্দ) প্রসাধন বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি করেছিলেন। চিকিৎসা শাস্ত্রের ওপর তিনি যে প্রামাণ্য গ্রন্থ ম্যানডেভিল রচনা করে গেছেন তার চব্বিশ পরিচ্ছেদেই রয়েছে প্রসাধন সংক্রান্ত আলোচনা। সেখানে সাবানের উল্লেখ আছে। বইটির দশটি অধ্যায়ে জরাকে ঠেকিয়ে রাখার উপায় লিপিবদ্ধ আছে।কসমেটিক সার্জারি চালু করার কৃতিত্বও তার।অন্যন্য দেশের শুরুর মত মধ্যযুগে ইংল্যান্ডে প্রসাধনের ব্যবহার অতীত ঐতিহ্য অনুযায়ী সম্পূর্ণরূপে চার্চের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিলো।

 

9.প্রসাধনীর শুরুটা যেভাবে (শেষ পর্ব)

রানী প্রথম এলিজাবেথ এ ধারার পরিবর্তন আনা শুরু করেন কিন্তু এর সাথে তিনি চার্চের পুরোহিতদেরও হাতে রাখতে চেয়েছিলেন। তাই রানী চার্চকে সন্তুষ্ট করতে ফরমান জারি করেছিলেন যে, কোনো নারী যদি কৃত্রিম কেশ, স্পেনীয় হেয়ার প্যাড, মেক-আপ, ফলস হিপ, হাইহিল জুতো ব্যবহার করে সম্রাজ্ঞীর কোনো প্রজাকে প্রলুব্ধ করে বিবাহ করে তবে তাকে ডাইনীর উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হবে। প্রসাধনকে শিল্পক্ষেত্রে ব্যাপকহারে বাজারজাত করে ইউরোপে নব জাগরণ এনেছিলো ফ্রান্স। তাই ফ্রান্সকে সমগ্র ইউরোপের প্রসাধনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ধরা হতো।