• সোমবার ১৩ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৩০ ১৪৩১

  • || ০৪ জ্বিলকদ ১৪৪৫

বাসে পেট্রোল বোমা হামলা: ৭ বছরেও থামেনি স্বজনদের কান্না

– নীলফামারি বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২  

আজ ৬ ফেব্রুয়ারি। গাইবান্ধার তুলসীঘাটে যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোল বোমা হামলার ৭ বছর। ২০১৫ সালের এই দিনে আগুনে প্রাণ হারায় শিশুসহ আট নারী-পুরুষ। বর্বরোচিত হামলার ঘটনায় বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের ৭৭ নেতাকর্মীকে অভিযুক্ত করে আদালতে চর্জশিট দেওয়া হলেও শেষ হয়নি বিচার কার্যক্রম। এতে ক্ষুব্ধ ও হতাশ হতাহতের স্বজনরা।

তবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলছেন, চার্জ গঠনের পর এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। আগামি ১৪ মার্চ মামলার পরবর্তী দিন ধার্য করা হয়েছে। দ্রুতই মামলার বিচারকাজ শেষ করার আশা রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর।

জানা গেছে, ২০১৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি দেশজুড়ে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা টানা হরতাল-অবরোধের সময় গাইবান্ধা সদরের তুলশীঘাটের বুড়িরঘর নামক এলাকায় পুলিশ পাহাড়ায় রাত ১০টার দিকে ঢাকাগামী নাপু এন্টারপ্রাইজের একটি নৈশকোচে পেট্রোল বোমা ছোঁড়ে দুর্বৃত্তরা। পেট্রোল বোমার আগুনে ঘটনাস্থলেই দগ্ধ হয়ে মারা যায় শিশুসহ ৬ জন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ২ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় দগ্ধ হয় শিশুসহ অন্তত ৩৫ জন যাত্রী।

পেট্রোল বোমা হামলার ৭ বছর পার হলেও সেই ভয়াবহ স্মৃতি ও স্বজন হারানোর বেদনা ভুলতে পারেননি অনেকেই। আহত অনেকেই শরীরে ক্ষত চিহ্ন নিয়ে বেঁচে আছেন। ঘটনার পর সরকারিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো সামান্য সহায়তা পেলেও তাদের আর কেউ খোঁজ রাখেনি। জড়িতদের বিচার না হওয়ায় ক্ষোভ-হতাশা বাড়ছে হতাহতদের স্বজনদের মাঝে। দ্রুত ঘটনার বিচার ও জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানিয়েছেন তারা। 

সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চণ্ডিপুর গ্রামের তারা মিয়া বলেন, ‘আগুনে স্ত্রী-ছেলে-মেয়েকে হারিয়েছি। কিন্তু সাত বছরেও স্ত্রী-সন্তান হত্যার বিচার শুরু হয়নি। সেদিনের ঘটনা মনে হলে ভয়ে আঁতকে উঠি। অথচ হত্যাকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। দ্রুত দোষীদের কঠোর শাস্তির দাবি করেন তিনি।’

হামলার দিন বাসে থাকা বলরাম দাস নামে এক দিনমজুর বলেন, ‘স্ত্রী-মেয়েকে নিয়ে ঢাকার বালুগাঁ এলাকায় শ্রমিকের কাজ করতাম। বাড়ি থেকে ঢাকা যাওয়ার সময় বাসে আগুন ধরে যায়। ঘটনার সময় মেয়ে তার মায়ের কোলে ঘুমিয়ে ছিল। আগুন দেখে স্ত্রীকে নিয়ে দ্রুত বাস থেকে নামলেও মেয়ে আগুনে পুড়ে মারা যায়। আগুনে আমরাও দগ্ধ হয়। এখনো শরীরে ক্ষতচিহ্ন নিয়ে বেঁচে আছি। 

৭ বছর পার হলেও চাঞ্চল্যকর এই মামলার তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। বর্বরোচিত এই নাশকতার ঘটনার পরের দিন বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের ৬০ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ৩০ জনকে আসামি করে সদর থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে একটি মামলা করে পুলিশ।

পরবর্তীতে মামলার এক বছর পর তদন্ত শেষে ও মেডিক্যাল রিপোর্ট পাওয়ার পর ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে ৭৭ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। এরপর জেলা দায়রা জজ আদালতে অভিযুক্ত আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন হয়। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জ গঠন হয়। 

কিন্তু ঘটনার কয়েকদিন পরই অভিযুক্ত প্রধান আসামি মোস্তফা মঞ্জিল আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে আরও চার আসামির মৃত্যু হয়। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে মামলার অপর আসামি সাহাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহাবুবুর রহমান টুলুর মৃত্যু হয়।

আসামিদের মৃত্যুজনিত কারণে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণে সৃষ্টি হয় জটিলতা। ফলে থমকে যায় মামলার বিচার কার্যক্রম। বর্তমানে চার্জশিটভুক্ত আসামিদের মধ্যে বরাবরই পলাতক চারজন ছাড়া ৬৭ জন উচ্চ আদালত থেকে জামিনে আছেন। এর মধ্যে একজন জামিনে পলাতক রয়েছেন।

গাইবান্ধা জেলা জজ ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফারুক আহম্মেদ প্রিন্স বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জ গঠন হলেও অভিযুক্ত ৫ আসামির মৃত্যুজনিত কারণে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হতে বিলম্ব হয়েছে।

বর্তমানে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। তবে আইনী প্রক্রিয়ার কারণে বিচার কার্যক্রমে কিছুটা জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতা হচ্ছে। তবে এ পর্যন্ত ১০১ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র দুইজনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। আগামী ১৪ মার্চ মামলার পরবর্তী দিন ধার্য করা হয়েছে। দ্রুতই মামলার বিচারকাজ শেষ করার আশা রাষ্ট্রপক্ষের এ আইনজীবীর।

প্রসঙ্গত, ঢাকাগামী নাপু এন্টারপ্রাইজের কোচটি ২০১৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সীচা পাঁচপীর থেকে ৫০-৬০ জন যাত্রী নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়। পথে গাইবান্ধা-পলাশবাড়ী সড়কের পল্লীবিদ্যুৎ অফিসের সামনে রাত সাড়ে ১০টার দিকে বুড়িরঘর নামক স্থানে বাসটি পৌঁছালে দুর্বৃত্তরা পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে পালিয়ে যায়। এতে কোচটিতে আগুন ধরে যায় এবং ঘটনাস্থলে ছয়জন নিহত হয়। পরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ২ জনের মৃত্যু হয়।

নিহতরা হলেন- সদর উপজেলার মালিবাড়ি ইউনিয়নের আব্দুল গফুর মিয়ার ছেলে আবুল কালাম আজাদ (৩০), খোলাহাটি ইউনিয়নের পশ্চিম কোমরনই গ্রামের জিলহজ আলী (৩৫), সুন্দরগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ কালীর খামার গ্রামের খয়বর হোসেন দুলুর ছেলে সৈয়দ আলী (৪২), পশ্চিম সীচা গ্রামের সাইব মিয়ার মেয়ে হালিমা বেগম (৪২), চন্ডিপুর গ্রামের শাজাহান আলীর ছেলে সুমন মিয়া (২২), একই গ্রামের বলরাম দাসের মেয়ে শিল্পী রানী দাস (১০), চন্ডিপুর গ্রামের তারা মিয়ার ছেলে সুজন মিয়া (১০) ও তার স্ত্রী সোনাভান বিবি (৪৫)।