• সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৫ ১৪৩১

  • || ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

এনআরসির কারণে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক পতনের সম্ভাবনা

– নীলফামারি বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৩০ মার্চ ২০২৪  

ভারত একটি প্যান-ইন্ডিয়া ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন (এনআরসি) প্রতিষ্ঠা করতে পারে বলে সন্দেহ ও উদ্বেগের ছায়া ঝুলে আছে। বাংলাদেশ, ভারতের প্রতিবেশী হওয়ায় একটি দীর্ঘ সীমানা রয়েছে, যা দুই দেশের মানুষের মধ্যে যাতায়াত ও পণ্য বিনিময় সহজ করে তোলে। তবে এনআরসি বাস্তবায়ন এই ভারসাম্যকে বিপর্যস্ত করার হুমকি তৈরি করেছে।

ভারতের ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস (এনআরসি) একটি বিতর্কিত ইস্যু হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা দেশজুড়ে বিতর্ক ও বিভাজনের জন্ম দিয়েছে। প্রাথমিকভাবে এটি আসাম রাজ্যে অনথিভুক্ত অভিবাসীদের চিহ্নিত করার জন্য চালু করা হয়েছিল। ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দেশব্যাপী এনআরসি কার্যকর করার ঘোষণা করেছিলেন। এমনকি তিনি একটি সময়সীমা নির্ধারণ করতে গিয়েছিলেন, ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি ‘অবৈধ অভিবাসীদের’ তাড়িয়ে দেবে।

যদিও তখন নরেন্দ্র মোদি দিল্লিতে একটি সমাবেশে বলেছিলেন, বিজেপির দেশব্যাপী এনআরসি নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে বিজেপি নির্বাচনের ঠিক আগে তাদের সিএএ প্রবিধান ঘোষণা করেছে, যা দেখে মনে হচ্ছে ভারত দেশব্যাপী এনআরসির পথে হাঁটছে।

নির্বাচনী প্রচারণার জন্য বিজেপির এই লক্ষ্য ভালো লাগতে পারে, কিন্তু আজ অবধি ভারত ২০২১ এর জন্য নির্ধারিত আদমশুমারি পরিচালনা করেনি বা একটি আপডেটেড এনআরসি সংকলন করেনি, যা ভারতীয় নাগরিকদের এনআরসি তৈরির দিকে প্রথম পদক্ষেপ বলে মনে করা হয়।

আসামে এনআরসি পদ্ধতিতে সম্পূর্ণরূপে বিপর্যয় ঘটেছে। সুপ্রিম কোর্ট একাধিক অসমীয়া সংস্থার কাছ থেকে এনআরসির খসড়া সংশোধনের জন্য পিটিশন পেয়েছে, যা প্রক্রিয়াটিকে আটকে রেখেছে। রাজ্যের বিজেপি নেতৃত্বাধীন প্রশাসন নিজেরাও বর্তমান এনআরসি খসড়াটি গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে। দাবি করেছে- কিছু নাম ভুলভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বা বাদ দেওয়া হয়েছে।

নাগরিকরা যখন এনআরসি স্ট্যাটাস ঠিক করার জন্য ফরেনার ট্রাইব্যুনালের (এফটি) কাছে আবেদন শুরু করবে তখন অনিবার্য দুর্নীতির ঘটবে। দেশব্যাপী এনআরসির ক্ষেত্রে এটি একটি জীবন্ত দুঃস্বপ্ন হবে। ভারতীয় সিনিয়র অ্যাডভোকেট সঞ্জয় হেজ বলেছেন, ১.২৫ বিলিয়ন জনসংখ্যার সঙ্গ আপনি কীভাবে এই প্রক্রিয়াটি সম্পাদন করবেন, যার মধ্যে ৭০০ থেকে ৮০০ মিলিয়ন মানুষের জন্ম সনদই নেই।’

যদিও সবচেয়ে উদ্ভট সমস্যাটি হলো- দেশব্যাপী এনআরসি করার লক্ষ্য দেশের ‘সত্যিকারের নাগরিকদের’ চিহ্নিত করা কিন্তু শেষ পর্যন্ত পর্যাপ্ত নথিপত্র না থাকার কারণে ভারতীয়দেরই আফগান, পাকিস্তানি বা বাংলাদেশি বলে ‘সিএএ’ পদ্ধতির মাধ্যমে আবেদন করতে বাধ্য করবে।

ভারত এর আগে ঢাকাকে আশ্বস্ত করেছে যে, এনআরসি একটি অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। এই ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্তিকর বিবৃতিটি সম্ভব নয়, কারণ ভারতে পাবলিক ও মিডিয়া ডিসকোর্স সাধারণত অবৈধ অভিবাসীদেরকে বাংলাদেশিদের সমতুল্য মনে করে। তথাকথিত ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ কী ঘটবে সে সম্পর্কে এখনো কোনো স্পষ্ট নির্দেশিকা নেই। তবে উচ্ছেদের ক্ষেত্রে তাদের চূড়ান্ত গন্তব্য হবে বাংলাদেশ।

ভারত থেকে গণ বিতাড়নের সম্ভাবনা একটি গুরুতর মানবিক এবং কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ হবে। বাংলাদেশ এরই মধ্যেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বোঝায় রয়েছে, যাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর সম্ভাবনা নেই। এরই মধ্যে বিশ্বের নবম-সর্বোচ্চ জনসংখ্যার ঘনত্ব থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ বর্তমানে ক্যাম্পে বসবাসকারী ১.১ মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আতিথেয়তা করছে এবং আরো অভিবাসী গ্রহণ করার মতো অবস্থানে নেই।

উচ্চ দারিদ্র্য ও অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জের কারণে এরই মধ্যেই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া বাংলাদেশের জন্য একটি আর্থ-সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া, রোহিঙ্গাদের বহিরাগত হিসেবে অব্যাহত ধারণার কারণে মাঝে মাঝে হোস্ট সম্প্রদায় এবং উদ্বাস্তুদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়া জনসংখ্যাকে রাখতে বাধ্য করা হলে বাংলাদেশ একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে।

এনআরসির প্রভাব বাণিজ্য, নিরাপত্তা ও বিনিময়সহ জনগণের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হতে পারে। এনআরসি সম্পর্কিত যেকোনো বিরোধ বাংলাদেশকে চীনের দিকে ঠেলে দেয়, যা বর্তমানে তার বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। ভারত বাংলাদেশকে হারাতে পারে, যা একটি উদীয়মান ‘সংযোগের কেন্দ্র’ এবং অ্যাক্ট ইস্ট নীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

লাখ লাখ লোকের সম্ভাব্য স্থানচ্যুতি মৌলবাদ ও চরমপন্থার জন্য উর্বর ভূমি তৈরি করতে পারে। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই যে, বাংলাদেশিরা বা তার সমাজের অন্তত একটি অংশ ভারত বিরোধী মনোভাব পোষণ করে, যার কারণে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ, কয়েক দশক ধরে তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যু এবং ভারতীয় বিএসএফ (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স) কর্তৃক সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের কারণে এই সমস্যাটি বারবার বাংলাদেশিদের মধ্যে জনসাধারণের অবজ্ঞা ও অবজ্ঞার কারণ হয়েছে। সিএএ এবং এনআরসি দুটি জাতির মধ্যে এরই মধ্যেই অবজ্ঞার জ্বলন্ত শিখা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। 

শেষবার যখন অভিবাসী ইস্যুটি ব্যাপক গতি পেয়েছিল তখন ১৯৭৯ সালে আসামে এর ফলে বাঙালি বংশোদ্ভূত ৫০০০ জনেরও বেশি মুসলমানের মৃত্যু হয়েছিল । এরই মধ্যেই সিএএ প্রবিধান দ্বারা ক্ষুব্ধ, বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী ব্লকগুলো প্যান-ইন্ডিয়ান এনআরসিকে ইসলামের উপর আরো আক্রমণ হিসাবে দেখবে। বিশেষ করে যদি নির্বাসিতরা প্রাথমিকভাবে মুসলিম হয়। এটি দেশের হিন্দু জনসংখ্যাকে লক্ষ্য করার লাঠি হয়ে উঠতে পারে। ভারতের জেনোফোবিয়ার কৌতূহলী ঘটনা বাংলাদেশকে তার নোংরা রাজনীতিতে টেনে নেবে।

বিজেপি সরকারকে অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে যে এনআরসি আর কোনো অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয় যদি এটি আন্তঃসীমান্ত মানবিক সংকট সৃষ্টির ঝুঁকি রাখে। অবৈধ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ লোকদের জন্য গণনির্বাসন বা কারাগারের ব্যবস্থা স্থাপন অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং একটি গণতান্ত্রিক ও মানবিক দেশ হিসাবে ভারতের মূল্যবোধের পরিপন্থী। যদি পরিবারগুলোকে বিভক্ত করার মূল্যে মানুষ তাদের বাড়ি থেকে উৎখাত হয় এবং দুর্বল জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ে, ভারতের প্রকৃত নাগরিকদের তালিকা জয় করা একটি অর্জন কিনা তা নিয়ে ভারতকে ভাবতে হবে।