• শুক্রবার ১০ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২৭ ১৪৩১

  • || ০১ জ্বিলকদ ১৪৪৫

আল্লাহর গজবে যেভাবে ধ্বংস হলো ৬ জাতি

– নীলফামারি বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২  

মানুষকে এক আল্লাহর পথে ডাকা, কালেমার দাওয়াত দেওয়া, তাওহিদের বাণী প্রচার করা, মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে আসাই ছিল নবী-রাসূল পাঠানোর অন্যতম উদ্দেশ্য। কিন্তু মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে যখনই নবী-রাসূলরা তাদের স্বজাতির কাছে দাওয়াত নিয়ে এসেছেন, তখনই তারা তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে; মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া। তারা নবী-রাসূল ও আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-বিধানের তোয়াক্কা না করে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য প্রদর্শন, একগুঁয়েমি ও পেশিশক্তির প্রভাব দেখাতো। শিরক-কুফরি থেকে শুরু করে যাবতীয় অন্যায়, পাপ ও জুলুম-অত্যাচারে লিপ্ত থাকতো।

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তাদের পাপরাশির কারণে তাদের (প্লাবনে) ডুবিয়ে মারা হয়েছিল। অতঃপর তাদের (কবরের) অগ্নিতে প্রবেশ করানো হয়েছিল। কিন্তু নিজেদের জন্য আল্লাহর মোকাবেলায় কাউকে তারা সাহায্যকারী পায়নি।’ (নূহ ৭১/২৫)

যুগে যুগে আল্লাহ তায়ালা অনেক শক্তিশালী ও ক্ষমতাধর জাতি-গোষ্ঠীকে ধ্বংস করে দিয়েছেন তাদের মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি, অবাধ্যতা ও পাপের কারণে। এরকম আল্লাহর গজবে ধ্বংসপ্রাপ্ত বিশ্বের প্রধান ছয়টি জাতি হলো- ‘কাওমে নূহ’, ‘কাওমে আদ’, ‘কাওমে ছামুদ’, ‘কাওমে লূত’, ‘আহলে মাদইয়ান’, ‘কাওমে ফিরআউন’।

আজ রইলো প্রথম পর্ব-

নুহ (আ.)-এর জাতি
নুহ (আ.)-এর জাতি মূর্তিপূজা করতো। আল্লাহ তায়ালা নুহ (আ.)-কে সুদীর্ঘ জীবন দান করেছিলেন। তিনি প্রজন্মের পর প্রজন্মকে মূর্তিপূজা ত্যাগ করতে বলেছেন। কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী অক্লান্তভাবে দাওয়াত দেওয়ার পরও তারা ইমান আনেনি। তিনি তার জাতিকে সত্যের পথে আনতে দীর্ঘ ৯৫০ বছর নিরলস চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। কিন্তু তারা নুহ (আ.)-এর দাওয়াত তাচ্ছিল্যভরে প্রত্যাখ্যান করে। তারা তাকে বলেছিল, ‘হে নুহ! যদি তুমি বিরত না হও, তবে পাথর মেরে তোমার মস্তক চূর্ণবিচূর্ণ করে দেওয়া হবে।’

বহু চেষ্টায় অল্পসংখ্যক মানুষ তার পথে এসেছিল। তার সময়ের সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা তার কথায় কর্ণপাত করেনি। নুহ (আ.) তাদের আল্লাহর শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করেন। তবু তাদের চৈতন্যোদয় হয়নি। অবশেষে আল্লাহর আজাব আসে। এক ভয়ংকর প্লাবন ও জলোচ্ছ্বাস তার জাতির অবাধ্য লোকদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এমন প্লাবন সেই জাতিকে গ্রাস করেছিল, যেই প্লাবন হাজার বছর ধরে পৃথিবীতে ইতিহাস হয়ে আছে। তখন নুহ (আ.)-এর নৌকায় যারা আশ্রয় নিয়েছিল তারাই রক্ষা পেয়েছিল।

মুসা (আ.)-এর জাতি
নিজেকে খোদা দাবি করেছিল ফেরাউন। তার কাছে ইমানের দাওয়াত নিয়ে গিয়েছিলেন মুসা ও হারুন (আ.)। বিনিময়ে মুসা (আ.)-কে হত্যা করতে মনস্থির করে ফেরাউন। সদলবলে ফেরাউন একদিন মুসা (আ.)-কে ধাওয়া করে। তিন দিকে ঘেরাও হওয়া মুসার দলের সামনে ছিল উত্তাল সাগর। আল্লাহর হুকুমে সাগরে পথ সৃষ্টি হয়। নিজের দল নিয়ে মুসা (আ.) এই পথ দিয়ে সমুদ্র পার হয়ে যান। কিন্তু সাগরে ডুবে মারা যায় ফেরাউন। আল্লাহ তাকে পৃথিবীবাসীর কাছে দৃষ্টান্ত হিসেবে রেখে দিয়েছেন। তিন হাজার বছরেরও বেশি সময় সাগরে নিমজ্জিত থাকার পরও তার লাশে কোনো পচন ধরেনি।

জানা যায়, ১৮৯৮ সালে কিংস ভ্যালির থিবিসে দ্বিতীয় রামাসিসের পুত্র ও মহাযাত্রাকালীন ফেরাউনের মমি করা লাশ আবিষ্কার করা হয়। সেখান থেকে তা কায়রোতে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯০৭ সালের ৮ জুলাই মমিটির আবরণ অপসারণ করা হয়। কয়েকটি জায়গায় কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও মমিটি তখনো সন্তোষজনকভাবে সংরক্ষিত ছিল। তার গলা থেকে মাথা পর্যন্ত উন্মুক্ত অবস্থায় রেখে অবশিষ্ট দেহ কাপড়ে ঢাকা অবস্থায় পর্যটকদের দেখার জন্য কায়রো জাদুঘরে রাখা আছে।

ঐতিহাসিক চিহ্ন-দ্রব্য সংরক্ষণ করা মানুষের স্বাভাবিক কর্তব্য। কিন্তু এ মমির ক্ষেত্রে সেই কর্তব্য অনেক বেশি বড় ও ব্যাপক হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ এ মমি হচ্ছে এমন একজনের লাশের বাস্তব উপস্থিতি, যে মুসা (আ.)-কে চিনতো। তার পরও সে তার হেদায়েত প্রত্যাখ্যান করেছিল। আত্মরক্ষার্থে পলায়নকালে মুসার পশ্চাদ্ধাবন করেছিল এবং সেই প্রক্রিয়ায় প্রাণ হারিয়েছে। কোরআনের বর্ণনা অনুযায়ী, তার লাশ পরবর্তী সময় মানুষের জন্য নিদর্শনস্বরূপ। আল্লাহর হুকুমে তা ধ্বংস থেকে রক্ষা পেয়েছিল।

সিনাই উপদ্বীপের পশ্চিম সাগরতীরে যেখানে ফেরাউনের লাশ সাগরে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল, আজও জায়গায়টি অপরিবর্তিত আছে। বর্তমানে এ জায়গার নাম জাবালে ফেরাউন বা ফেরাউন পর্বত। এরই কাছাকাছি আছে একটি গরম পানির ঝরনা। স্থানীয় লোকেরা এর নাম দিয়েছে হাম্মামে ফেরাউন। এর অবস্থানস্থল হচ্ছে আবু জানিমের কয়েক মাইল ওপরে উত্তরের দিকে।

হুদ (আ.)-এর আদ জাতি
আদ জাতির লোকেরা ছিল উন্নত। নির্মাণশিল্পে তারা ছিল জগৎসেরা। তারা সুরম্য অট্টালিকা ও বাগান তৈরি করত। তাদের তৈরি ইরাম-এর মতো অনিন্দ্য সুন্দর শহর পৃথিবীর আর কোথাও ছিল না। তারা অঙ্কন শিল্পেও ছিল দক্ষ। জ্ঞান-বিজ্ঞানে তারা যেমন অগ্রসর ছিল, তেমনি সংস্কৃতিতেও অনন্য।

শুরুর দিকে আদরা হজরত নুহ (আ.)-এর ধর্মমত মেনে চলত। তারা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করত। কিন্তু কালক্রমে তারা আল্লাহকে ভুলে যেতে শুরু করে। তারা মনে করত, তাদের সব অর্জন স্বীয় যোগ্যতায়।

আদরা ভুলে গেল, আল্লাহ বা স্রষ্টা বলতে কেউ আছেন। তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা যে আল্লাহই তাদের দিয়েছেন, তাও তারা বেমালুম ভুলে গেল। ফলে তারা অহংকারী হয়ে উঠল এবং সত্যিকারের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ল।

আদ জাতির লোকদের সতর্ক করার জন্য আল্লাহ হজরত হুদ (আ.)-কে দুনিয়ায় পাঠালেন। হজরত হুদ (আ.) আদ জাতির লোকদের গর্ব পরিত্যাগ করার আহ্বান জানালেন এবং আল্লাহর ইবাদত করার উপদেশ দিলেন। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে জীবন পরিচালনার কথাও বললেন। হজরত হুদ (আ.) বললেন, ‘তোমরা মজবুত অট্টালিকা বানিয়েছ এ জন্য যে, তোমরা এখানে চিরকাল থাকবে। তোমরা যখন তোমাদের দুর্বলের ওপর জুলুম করো তখন তোমরা স্বৈরশাসকের মতো বর্বর আচরণ করো। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আমাকে মান্য করো।

কিন্তু লোকেরা হুদ (আ.)-এর কথা শুনল না, বরং তারা তার কথা প্রত্যাখ্যান করল। তাকে বোকা ও মিথ্যাবাদী বলে গালাগাল দিল। নবীর প্রতি এরূপ অন্যায় আচরণে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হলেন। ফলে আদদের এলাকায় দেখা দিল প্রচণ্ড খরা। এতে তিন বছর তারা দুর্ভিক্ষের মধ্যে কাটাল। তারপরও তাদের স্বভাব-চরিত্রে কোনো পরিবর্তন হলো না। এবার সেখানে শুরু হলো ভয়ানক ঝড়। এই ঝড় সাত রাত ও আট দিন ধরে চলল। ফলে গোটা আদ এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো। আল্লাহ তার রহমতে হজরত হুদ (আ.) ও তার অনুসারীদের রক্ষা করলেন।