• শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

ফুরফুরে মেজাজে উত্তরের কৃষকঃ চলছে ধানের কাটাই-মাড়াই ও আলুবীজ বপন

– নীলফামারি বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯  

বর্তমান সরকারের কৃষি বিপ্লবে উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা আজ অতীত। অভাব-অনটন থাকার আর কোন কারণ নেই। ফসল উৎপাদনে কৃষক এখন বেশ সফল। কৃষকের ঘরে ঘরে ফুরফুরে মেজাজ। প্রকৃতিতে এখন শরৎ ঋতু। টানা কয়েকদিনের বৃষ্টির পর ক্রমশ কমছে তাপমাত্রা। বাতাসে হিমের ছোয়া। রাতে মৃদু কুয়াশা। হালকা ঠান্ডা উত্তরবঙ্গে। ভোরের রাঙা প্রভাতে দূর্বাঘাসের ওপর শিশিরবিন্দু চোখে পড়ছে।

১১ বছর আগেও রংপুর অঞ্চলের ৫ জেলায় আশ্বিন-কার্তিক অভাবের মাস নামে পরিচিত ছিল। এ সময়ে গ্রামের কৃষকের ঘরে খাবার ও কৃষিশ্রমিকের হাতে কাজ থাকত না। হাজার হাজার কৃষক ও কর্মজীবীকে চরম অভাবের মাঝে পড়তে হয়েছিল। এ অবস্থায় অভাবী মানুষ জীবিকা নির্বাহ করার জন্য দেশের বিভিন্ন জেলায় কাজের সন্ধানে ঘুরে বেড়াত। এছাড়া আগাম শ্রম বিক্রিসহ বাড়ির হাঁস-মুরগি, গাছপালা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকত। সেদিন এখন আর নেই। গ্রামের কৃষকই বলছেন ফসলের বহুমুখীকরণ ও আগাম ফসল উৎপাদনে শেখ হাসিনা সরকারের কৃষি বিপ্লব কৃষকের ভাগ্য পরিবর্তন করে দিয়েছে।

বাংলা মাসের ভাদ্র শেষ। আশ্বিনের শুরুতেই মঙ্গা তাড়ানোর আগাম ধান কৃষকের ঘরে উঠেছে। উত্তরবঙ্গের রংপুর অঞ্চলের নীলফামারীসহ ৫ জেলায় মঙ্গা তাড়ানোর স্বল্পমেয়াদী হিরা, ব্রি-৩৩, ব্রি ৩৯, ব্রি ৫৬, ব্রি ৫৭, ব্রি ৬২ ও বিনা-৭ জাতের ধান আবাদ করেছে কৃষক। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট রংপুর অঞ্চলে ৫ জেলায় আশ্বিন-কার্তিক মাসে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে কৃষকের মাঝে স্বল্পমেয়াদী জাতের ধানবীজ সরবরাহ করে। এ ধানের জীবনকাল ৯০-১১০ দিন। যেখানে অন্য ধানের জীবনকাল ১৪০-১৫০ দিন। এলাকার কৃষক এ ধানের নাম দিয়েছে মঙ্গা তাড়ানো ধান। এ ছাড়া আশ্বিন-কার্তিক মাসে এই ধান ঘরে তুলতে কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়। তাছাড়া এর খড় গোখাদ্যের চাহিদাও পূরণ করে। নীলফামারী সদরের হাতিবান্ধা গ্রামের কৃষক ইউনুছ আলী দুই বিঘা জমিতে এই ধানের আবাদ করেছিলেন। তিনি জানান, পুরো আমন ধান কাটা-মাড়াইয়ের অনেক আগে এই ধান ঘরে তোলা যায়। এতে দূর হয়েছে সংসারের অভাব।

সরেজমিনে দেখা যায়, একদিকে আগাম ধান কাটাই-মাড়াই অন্যদিকে সেই ধানের জমিতে চলছে আগাম আলু বুননের কাজ। কাজের মঝেই খাওয়ার সময়টুকু মাঠেই সেরে ফেলছে কিষান-কিষানী। কৃষকবধূ হাসিমুখে গরম গরম ভাত আর তরকারি এনে খাইয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরছে। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে খোশ আনন্দে কৃষক ফের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ছে জমিতে।

প্রতি বছরের ন্যায় কৃষি বিভাগের আলু চাষ ও উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের আগেই উত্তরের কৃষক আগাম আলু আবাদ করে থাকেন। এবারও আলু বুননের ধুম ফেলেছে। এই আলু আগামী ৫৫ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে বাজারে বিক্রি হবে।

শুক্রবার সরেজমিনে দেখা যায়, দেশের আগাম আলু উৎপাদনের সূতিকাগারখ্যাত নীলফামারীর কিশোরীগঞ্জ, জলঢাকা ও নীলফামারী সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে আলু বুননে ব্যস্ত সময় পার করছে কৃষক। পাশাপাশি উৎপাদিত আগাম ধানের কাটাই-মাড়াই চলছে। কৃষি বিভাগ জানায়, চলতি বছর রংপুর কৃষি অঞ্চলের ৫ জেলা প্রায় ৬ লাখ হেক্টর জমিতে রোপা আমন ধান চাষ করেছে।

এর মধ্যে মঙ্গা তাড়ানোর আগাম ও স্বল্পমেয়াদী জাতের ধান হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার ৯৪৩ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে নীলফামারীতে ৭ হাজার ৭৮৫ হেক্টর, লালমনিরহাটে ৬ হাজার ১৭৫ হেক্টর, কুড়িগ্রামে ৫ হাজার ৫১৬ হেক্টর, রংপুরে ১৬ হাজার ৫১৯ হেক্টর ও গাইবান্ধায় ৪ হাজার ৯৪৮ হেক্টর। কৃষি বিভাগ বলছে, এটি স্বল্পমেয়াদী ও আগাম জাতের ধান। এই ধান কাটাই- মাড়াই শেষে রবি ফসলের চাষ শুরু করেছে কৃষক। রবি ফসলের মধ্যে রয়েছে আগাম আলু, ফুলকপি, বাঁধাকপি ও শাক সবজি । শীতের আগাম এই রবি ফসল উৎপাদনে কৃষককুল অনেকাংশে লাভের মুখ দেখে থাকেন। সেই সঙ্গে সাথী ফসল উৎপাদন হয়। একই জমিতে আদা চাষের সঙ্গে বেগুন, কাঁচামরিচ, লাউ, করলা ও পেঁপে রয়েছে। কিশোরীগঞ্জ উপজেলার উত্তর দুরাকুটি,নিতাই, মাগুরা,পুঁটিমারী, কালিকাপুরে দেখা যায়, কেউ আগাম ধানের কাটাই-মাড়াই করছে আবার কেউ কেউ জমিতে আগাম আলুর বীজ বুনছেন। চারদিকে যেন ফসল উৎপাদনের উৎসব পড়েছে। ফলে ফুরফুরে মেজাজে রয়েছেন এখানকার কৃষক। এ বছর আলু বীজের দাম তুলনামূলক কম, সারের সরবরাহ স্বাভাবিক ও স্বল্প মজুরিতে কৃষিশ্রমিক মেলায় উপজেলার কৃষক আগাম জাতের আলু আবাদে ঝুঁকে পড়েছেন। বাহাগিলি ইউনিয়নের উত্তর দুরাকুটি গ্রামের কৃষক শামীম হোসেন বলেন, বাজারে যার আলু যত আগে উঠবে, তার লাভ তত বেশি হবে। তিনি গত মৌসুমে সাড়ে ১১ একর জমিতে আলু চাষ করে ১ হাজার ৫০০ বস্তা আলু পেয়েছিলেন। এর মধ্যে মৌসুমের শুরুতেই ৪০০ বস্তা বিক্রি করেন। ১ হাজার ১০০ বস্তা হিমাগারে রাখেন। উৎপাদন খরচ ও হিমাগার ভাড়াসহ প্রতি বস্তায় (৮৪ কেজি) খরচ পড়ে ৯৫০ টাকা। সেই আলু বস্তাপ্রতি তিনি বিক্রি করেছেন গড়ে ১ হাজার ৬০০ টাকা করে। লাভ বেশি পাওয়ায় এবার তিনি ১৫ একরে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে আলু লাগানো শুরু করেছেন।

মাগুরা ইউনিয়নের কৃষক সাবেদ আলী জানান, বিঘাপ্রতি জমিতে আগাম জাতের আলু রোপণে খরচ হচ্ছে ১০ হাজার টাকা। বিঘায় আলু উৎপাদন হবে প্রায় আড়াই হাজার কেজি। আগাম আবাদে আগাম বাজার ধরতে পারলে আলুর কেজি বিক্রি হবে প্রায় ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। এতে বিঘাপ্রতি আলু বিক্রি করে খরচ বাদ দিয়ে লাভ পাওয়া যাবে প্রায় ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। উপজেলার গাড়াগ্রাম ইউনিয়নের পূর্ব দলিরাম গ্রামের কৃষিশ্রমিক শাহজাহান আলী জানান, আগে বেকার থাকতে হতো আর এখন আগাম উৎপাদিত ধান ও আলু ক্ষেতে কাজ করে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা মজুরি পাওয়া যাচ্ছে। একই কথা জানালেন আরও কয়েক শ্রমিক। এলাকার কৃষকরা জানায়, নীলফামারী সদর,জলঢাকা ও কিশোরীগঞ্জ উপজেলায় প্রতিবছর ১০ হাজার হেক্টর জমিতে আগাম আলুচাষ হয়ে থাকে। আলুর মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এবারো আলু চাষী বেশিসংখ্যক জমিতে আলু আবাদে মাঠে নেমে পড়েছে। নিতাই গ্রামের লোকমান আলী বলেন, তিনি এবার মঙ্গা তাড়ানোর ধান আবাদ করেছেন ৩ বিঘা জমিতে। সেই ধান কাটাই-মাড়াই শেষে আগাম আলু বুনছেন।

পুঁটিমারী গ্রামের সাব্বির হোসেন বলেন, এর মাধ্যমে কাজের সঙ্কট দূর করা সম্ভব হয়েছে। এ বছর তিনি সাড়ে তিন বিঘা জমিতে আগাম ব্রি-৩৩ জাতের ধান রোপণ করেছিলেন। ফলনও ভাল হয়েছে বলে জানান। তিনি আরও জানান, উঁচু ও ডাঙ্গা সব জমিতেই বর্তমানে আলু চাষের কাজ চলছে। কেউ জমি তৈরি করছেন, কেউবা শ্রমিক নিয়ে ক্ষেতে আলুর বীজ বুনছেন। এখন উত্তরাঞ্চলের প্রায় জেলা, উপজেলায় এই আগাম আলু চাষ করা হচ্ছে। অন্য ফসলের চেয়ে বেশি লাভ হওয়ায় এ ফসলের দিকে ঝুঁকছেন কৃষক। ফলে মঙ্গাও পালিয়েছে। এখন আর না খেয়ে থাকতে হয় না এলাকার মানুষকে। মোটামুটি সবার পরিবারে সচ্ছলতা এসেছে এ ধরনের চাষাবাদের কারণে। নীলফামারী কৃষি সম্প্রসার অধিদফতরের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ জানালেন, কৃষক প্রতি বছরের ন্যায় স্বল্পমেয়াদী মঙ্গা তাড়ানোর ধান উৎপাদন করে সেই জমিতেই আগাম আলু লাগাচ্ছেন। গত বছর প্রায় ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়। দামও পেয়েছে ভাল। ধারণা করা হচ্ছে, এবার জেলায় চলতি মৌসুমে গতবারের চেয়ে বেশি জমিতে আলুর চাষ হবে। মাঠ পর্যায়ে কৃষককে পরামর্শ প্রদানে আমরা তৎপর।