• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

যুবকদের প্রতি ইসলাম কি বলে?

– নীলফামারি বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১৯ নভেম্বর ২০১৯  

জাতীয় জীবনে যুবকদের গুরুত্ব অপরিসীম। সুশীল সমাজ নির্মাণে, স্বনির্ভর সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গড়ার ক্ষেত্রে যুবকদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। দায়িত্ব আছে নিজের প্রতি, আপন মা-বাবা ও পরিবারের প্রতি এবং সমাজের মানুষসহ রাষ্ট্রের প্রতিও রয়েছে গুরত্বপূর্ণ দায়িত্বভার।

প্রত্যেক যুবকই কোনো না কোনো মা-বাবার সন্তান। সন্তানকে দৈহিক মানসিক সামাজিক এবং আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী শিক্ষা-দীক্ষায় সঠিকভাবে গড়ে তোলার মূল দায়িত্ব মা-বাবার। মা-বাবার দায়িত্ব হলো সন্তানকে নামাজ-রোজা, আদব-আখলাক শিক্ষা দেয়া। সততা, ধার্মিকতা, সৃষ্টির সেবা ও সৎকাজে আদেশ এবং অসৎকাজে নিষেধ করার প্রশিক্ষণ দিয়েও তাকে গড়ে তুলতে হবে। যুবকদের অন্তরে ঘৃণা সৃষ্টি করতে হবে সৃষ্টির অকল্যাণ, স্বার্থপরতা, ধোঁকাবাজি ও  মুনাফিকির প্রতি। মুক্ত রাখতে হবে সকল অশ্লীলতা ও মাদকের ভয়াল থাবা থেকে।

নেতৃত্ব:

সমাজিক ও রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব একদিন যুবকদের হাতেই ন্যাস্ত হবে। একটি রাষ্ট্রকে সমৃদ্ধ ও স্বনির্ভরশীল করতে হলে মুত্তাকি, সচ্চরিত্রবান এবং ন্যায়পরায়ণ দেশপ্রেমিকদের হাতে ক্ষমতা থাকা বাঞ্ছনীয়। ক্ষমতার চাবি যদি দুর্নীতিবাজ অসৎ লোকদের হাতে আসে তাহলে গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থা অন্যায়-অনাচারে ভরে উঠবে। সুস্থ চিন্তাধারা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, সভ্যতা-সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি ও বিচারব্যবস্থা  এবং সামাজিক অবকাঠামো সহ সবকিছুই বিপর্যস্ত হতে থাকবে। পত্র-পত্রিকা পড়লে বুঝা যায়, হঠাৎ করেই ঢাকা মসজিদের শহরের বদলে রূপান্তরিত হয়ে গেল ক্যাসিনো শহরে। ঢাকায় এখন ক্যাসিনো পাড়া, জুয়া পল্লী নামে খ্যাত। কোটি কোটি টাকা ও অবৈধ অস্ত্র নিয়ে ধরা পড়ছে সরকারি মদদপুষ্ট অনেক নেতা।

একটি পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয় রেজওয়ানুল হক চৌধুরী, গোলাম রাব্বানী ছাত্রলীগের পদ পাওয়ার পর থেকে ৭০ হাজার টাকা ভাড়াফ্লাটে  জীবন যাপন শুরু করে। টয়োটা কোম্পানির মাইক্রোবাস ব্যবহার করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পর্যন্ত ঈদ সালামি নামে ছাত্রনেতাকে ঘুষ দিতে হয়। এটা নষ্ট যুব সমাজ ও ছাত্ররাজনীতির সামান্য একটি উদাহরণ। আমাদের যুব সমাজকে যদি এই অবস্থা থেকে রক্ষা না করা যায় তাহলে পৃথিবী একদিন অন্যায় ও পাপাচারের অন্ধকারে হারিয়ে যাবে। সত্য ন্যায় ও কল্যাণের বারি-বিন্দু পৃথিবীর কোথাও খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। তাইতো কবি ফররুখ আহমদের কণ্ঠে আমরা শুনতে পাই আজকে ওমর পন্থী পথিক দিকে দিকে প্রয়োজন, পিঠে বোঝা নিয়ে পাড়ি দিবে যারা প্রান্তর প্রাণপন।

পবিত্র কোরআনের দৃপ্ত ঘোষণায় আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে নবী! অনেককে দেখবেন যারা পাপে সীমালঙ্ঘনে ও অবৈধ ভক্ষণে সদা তৎপর। তারা যা করে নিশ্চয়ই তা নিকৃষ্ট।’ রাসূলে কারিম (সা.) বলেছেন, ‘মুমিন ব্যক্তির প্রসন্নও ভদ্রভাবের হয়ে থাকে আর পাপিষ্ট ব্যক্তি প্রতারক ও নীচ প্রকৃতির হয়ে থাকে।’ (বুখারি শরিফ)।

চারিত্রিক অবক্ষয়:

বর্তমান সময়ের যুবক-যুবতীরা ভালোবাসার নামে পার্কে ফ্রী মেলামেশা করে। পর্যটন স্পটগুলোতে একান্তভাবে আড্ডা দেয়। গল্প-গুজব আর মেসেজ-আলাপের একপর্যায়ে অশ্লীল বেহায়পনা ও ব্যাভিচারে লিপ্ত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদীরা যুবক-যুবতীদের উম্মাদনাকে পুঁজি করে ভালবাসার নামে দৈহিক সম্পর্ক পথে-ঘাটে সহজলভ্য করে দিয়েছে। বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে নারীগমন, দৈহিক সম্পর্ক ব্যাপক হওয়ার কারণে এইডস নামক রোগ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। আমাদের যুব সমাজকে মরণব্যাধি এইডস নামক রোগ থেকে মুক্ত রাখতে হলে তাদের মধ্যে ধর্মীয় চেতনা এবং মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাতে হবে।

হজরত সুলাইমান ইবনে ইয়াসার (রহ.) প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ছিলেন। একবার হজের সফরে জনমানবহীন প্রান্তরে যাত্রা বিরতি দেন। তার সাথী কোনো কাজে শহরে চলে গেলে তিনি একাই থেকে যান। সে সময় তিনি তাবুতে খুব সুন্দরী এক রমণীর ঝলক দেখতে পান। সে সামনে দাঁড়িয়ে কিছু চাওয়ার ইশারা করল। তিনি ওই রমণীকে কিছু খাবার দিতে চাইলে সে বলল, আমি আপনার নিকট ওই জিনিসই চাচ্ছি যা কোনো পুরুষের কাছে একজন নারী চেয়ে থাকে। দেখো! তুমি যুবক, আমিও খুব সুন্দরী। আমাদের দু’জনের মিলনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশও আছে। তখন হজরত সুলাইমান ইবনে ইয়াসার (র.) তার কথা শুনে বুঝে গেলেন, শয়তান তার সারা জীবনের আমল নষ্ট করার জন্য এই রমণীকে পাঠিয়েছে। তিনি আল্লাহর ভয়ে দুই হাঁটুর মাঝে মাথা গুঁজে কাঁদতে লাগলেন। এতো কাঁদলেন যে, এই নারী লজ্জা পেয়ে চলে গেল।

ঠিক এই মুহূর্তে ওই সাথী শহর থেকে ফিরে এসে দেখতে পেলেন তার সাথী কাঁদছেন। বললেন, ভাই! কাঁদছেন কেন? তিনি পুরো ঘটনা খুলে বলেন। ঘটনা শুনে তার সাথীও কাঁদতে লাগল। জিজ্ঞাসা করা হলো, তুমি কাঁদছো কেন? বললেন, আমি কাঁদছি এইজন্য যে, তুমি তো এই নারীর ধোঁকা থেকে বেঁচে গেছো। আমার বেলা হয়তোবা বাঁচা খুব কঠিন ছিলো। এই কথা শুনে তিনি আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করলেন। গভীর রাতে স্বপ্নে হজরত ইউসুফ (আ.) এর সাথে দেখা হলো। ইউসুফ (আ.) বললেন, তোমাকে মোবারকবাদ। তুমি অলি হয়ে এমন কাজ করেছো যা নবী করেছিলো।

এসব ঘটনা আমাদের সামনে বিদ্যমান। এগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে জাগিয়ে তুলতে হবে। ইসলামের দৃষ্টিতে অশ্লীলতা হারাম; তা বর্জন করতে হবে। সমাজে তার প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বল, আমার প্রতিপালক হারাম করেছেন সকল প্রকার অশ্লীলতা। তা প্রকাশ্য হোক আর অপ্রকাশ্য হোক। (সূরা: আরাফ, আয়াত ৩৩)। পবিত্র কোরআনের অন্য জায়গায় ইরশাদ হচ্ছে, ‘তোমরা নিকটবর্তী হয়ো না ব্যাভিচারের। নিশ্চয় এটা অশ্লীল এবং নিকৃষ্ট আচরণ।’ (সূরা: আলে ইমরান, আয়াত: ৩২)। হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন, চক্ষুদয়ের ব্যভিচার হচ্ছে দৃষ্টিপাত করা। কর্ণদ্বয়ের ব্যভিচার শ্রবণ করা, জিহ্বার ব্যভিচার কথা বলা। হাতের ব্যভিচার স্পর্শ করা। পায়ের ব্যভিচার  পদক্ষেপ, আর অন্তরের ব্যভিচার মনে মনে কামনা করা।’

লিভটুগেদার:

বর্তমানে একটি পরিচিত শব্দ লিভ টুগেদার। দু’জন অবিবাহিত নারী পুরুষ স্বামী-স্ত্রী না হয়ে একসঙ্গে পারিবারিক পরিবেশে থাকাটাই লিভটুগেদার বলে বর্তমান মিডিয়ায় চাউর হচ্ছে। রাজধানীতে এ ধরনের অনৈতিক সম্পর্কে জড়াচ্ছে অনেকেই। যুবক-যুবতীরা আগ্রহী হয়ে উঠেছে এ ধরনের সম্পর্কে। এতে করে বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহ হারাচ্ছে তরুণরা। পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক হারে বেড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছেলে মেয়েদের লিভ টুগদোর। অনৈতিক কাজে উৎসাহী হচ্ছে তরুণ-তরুণীরা। আজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কী হচ্ছে খবরের কাগজ পড়ে হয়রান হয়ে যাচ্ছে দেশের মানুষ। তারা নিরাশ হয়ে যাচ্ছে ছাত্র সমাজের প্রতি। তাদের মারামারি-হানাহানি, চাঁদাবাজি এবং দলবদ্ধ ধর্ষণ সংস্কৃতি আজ অন্ধকারে ফেলছে দেশের মানুষকে। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়; বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা, গবেষণা, স্বদেশপ্রেম ও সংস্কৃতি চর্চা করার কিছুই কি থাকবে না?

সবাই শুধু ছাত্রনেতা হওয়ার জন্য কিংবা ক্যাডার হওয়ার জন্য ক্যাম্পাসে অবস্থান করে। প্রাচ্যের অক্সফোড নার্মে খ্যাত আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে লেখাপড়া করে দেশের মেধাবী সন্তানরা। বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেছে অনেক গবেষক, বিজ্ঞানী এবং দক্ষ হাতে দেশ পরিচালনাকারী। বর্তমানে অনেক নেতা আছেন, যাদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তাই দেশের কান্ডারী ছাত্রনেতাদের হতে হবে সুশিক্ষিত, আদর্শবান এবং ধার্মিক  চেতনার অধিকারী।

আমরা জানি, আজকের সমাজে পচন ধরেছে। ধীরে ধীরে অবক্ষয় দিকে যাচ্ছে। তার একমাত্র কারণ, আমরা ইসলাম ধর্মের মৌলিক শিক্ষা থেকে অনেক দূরে। ইসলাম আমাদেরকে শিক্ষা দেয় সঠিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা আর মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসা। ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয়, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যাওয়া দুর্নীতি-অনিয়ম, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী থেকে বেঁচে থাকার। তাই আজ বড় প্রয়োজন সঠিক ধর্ম চর্চার অনুকুল পরিবেশ। ধর্মই মানুষকে মানুষ হতে বলে। সৎ হতে বলে। যুব সমাজ ও ছাত্রসমাজকে শিক্ষা, ইবাদত, সমাজ গঠনমূলক কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে। কর্মমুখী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নিজের কর্মে নিজের জীবন চালানো যে সর্বোচ্চ মর্যাদার, তার প্রতি উৎসাহিত করতে হবে। কর্মবিমুখ, পরনির্ভরতা দুর্নীতি, এবং অসৎ পথে টাকা কামানোর  প্রতি নিরুৎসাহিত  করতে হবে। যে যুবক শ্রম ও কর্মে লিপ্ত, সে জিহাদের ময়দানে মুজাহিদের মতো সওয়াব লাভ করবে।

 

শোনো হে যুবক! তোমাদের দিকে জাতি তাকিয়ে আছে। তোমাদেরকে এই অবক্ষয় থেকে দেশকে মুক্তি দিতে হবে। দেশের হাল তোমাদেরই ধরতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ পদে তোমাদেরই একদিন বসতে হবে। দেশ পরিচালনার ভার তোমাদের হাতে একদিন ন্যাস্ত হবে। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গকিলোমিটার ভূখণ্ডকে তোমাদেরই রক্ষা করায় উদ্যোগী হতে হবে। তোমরা বড় করে স্বপ্ন দেখো, তাহলে একদিন তোমরাই বিজয়ী হবে ইনশাআল্লাহ!

কবি নজরুল বলেছেন, ‘এই তাওহিদ একত্ববাদ কালে কালে ভুলে এই মানব, হানাহানি করে ইহারাই হয় পাতালতলের ঘোর দানব।’ হাদিস শরিফে এসেছে পাঁচটি অবস্থার আগে পাঁচটি অবস্থার কদর করো, ‘বার্ধক্যের আগে যৌবনের কদর করো, অসুস্থতার আগে সুস্থতার কদর করো, অভাবের আগে স্বচ্ছলতার কদর করো। ব্যস্ততার আগে অবসরের কদর করো। মৃত্যুর আগে জীবনের কদর কর।’

আল্লাহ তায়ালা আমাদের যৌবনের কদর করে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর তৌফিক দান করুন। আমিন।