• বুধবার ০৮ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২৫ ১৪৩১

  • || ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫

বঙ্গবন্ধুর চেতনায় শিক্ষা ও শিক্ষক

– নীলফামারি বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৩ মার্চ ২০২১  

আবুল কাশেম উজ্জ্বল

বঙ্গবন্ধু শুধু একটি শব্দ বা উপাধি নয়, এটি একটি আবেগ, একটি আদর্শ ও একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি বিশ্বাস করতেন শিক্ষিত জাতি ছাড়া বাংলার মুক্তি সম্ভব নয় এবং তাঁর জীবন ও কর্মে তিনি শিক্ষার গুরুত্ব ও শিক্ষকের মর্যাদা, সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অত্যন্ত আন্তরিক, শ্রদ্ধাশীল ও আবেগপ্রবণ ছিলেন। তিনি শিক্ষার্থী হিসেবে ছিলেন বিনয়ী এবং শিক্ষকদের প্রতি ছিল অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। এর নমুনা দেখা যায় যখন তিনি তাঁর শিক্ষক পণ্ডিত সাখাওয়াত উল্লাহ পাটোয়ারী অন্যত্র চলে যাওয়ার সময় তাঁর বিছানাপত্রের গাঁটরি নিজের মাথায় করে পাটগাতি পৌঁছে দিয়েছেন। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী থাকাকালেও বঙ্গবন্ধু নির্দ্বিধায় শিক্ষকদের কাছে টেনেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু বলেই ১৯৭২ সালে তাঁর শিক্ষক বেজেন্দ্রনাথ সূত্রধরকে সরকারি বাসভবনে আমন্ত্রণ করে সমস্ত প্রটোকল ভেঙে গেটে এসে পায়ে ধরে সালাম করে সসম্মানে নিজের অফিসে নিয়ে নিজের আসনে বসিয়ে দেন।

শিক্ষকদের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার অনেক নিদর্শন পাওয়া যায় ‘অসামপ্ত আত্মজীবনী’তে। অনেক রাশভারী ও গম্ভীর শিক্ষকও তাঁকে বিশেষ স্নেহ করতেন, যেমনটা করতেন গোপালগঞ্জ খ্রিস্টান মিশনারি হাই স্কুলের শিক্ষক গিরিশ বাবু। শিক্ষকদের সিদ্ধান্ত বা আদেশকে তিনি যেভাবে শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে নিতেন তা ছিল অতুলনীয়। তিনি শিক্ষকদের কাজের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্তও করতেন। যেমনটা দেখা গেছে ছাত্রজীবনে তাঁর অন্যতম ‘আদর্শ’ শিক্ষক কাজী আবদুল হামিদের প্রতিষ্ঠিত ‘মুসলিম সেবা সমিতি’র জন্য কাজ করতে এবং পরবর্তী সময়ে এর দায়িত্ব নেওয়ার মাধ্যমে।

১৯৭০ সালে নির্বাচনী বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে বিনিয়োগকে উত্কৃষ্ট বিনিয়োগ বলে অভিহিত করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সালে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন উপহার দিয়েছেন, আইয়ুব খান প্রণীত ১৯৬২ সালের অধ্যাদেশ বাতিল করে ১৯৭৩-এ দেশের চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেছিলেন। তিনি শিক্ষকদের মর্যাদায় বিশ্বাস করতেন বলেই ১৯৭৪ সালে নোয়াখালী জেলায় সার্কিট হাউসে অবস্থানরত অবস্থায় একজন বৃদ্ধ শিক্ষক পরিচয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তিনি নিজেই দেখা করেন, রাতে থাকা-খাওয়ারও ব্যবস্থা করেন।

শিক্ষা ও শিক্ষকদের সবার ওপরে ভাবতেন বলেই স্বাধীনতার পর ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন এবং চরম আর্থিক সংকটের মাঝেও তাঁদের বেতন-ভাতার বিষয়ে কোনো আপস করেননি। তৎকালীন প্রাথমিক শিক্ষকদের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর সমান ১৪৫ টাকা বেতন স্কেল সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, একসময় প্রাথমিক শিক্ষকরা প্রথম শ্রেণির মর্যাদা ও বেতন পাবেন; সেদিন খুব বেশি দূরে নয়। আমাদের সৌভাগ্য, তাঁর মতো একজন ‘মানুষ’ পেয়েছিলাম, যিনি স্বপ্ন দেখতেন শিক্ষিত বাঙালি জাতির, তিনি বিশ্বাস করতেন শিক্ষকদের সর্বোচ্চ মর্যাদায়। অথচ আজ আমরা অনেক কিছু পেলেও শিক্ষা ও শিক্ষকের সম্মানের জায়গাটি সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। দেশে শিক্ষকদের জীবনে পরিবর্তন কতটা হয়েছে তা ভাবনার বিষয়।

শিক্ষকের জীবনে প্রাপ্তি বলতে দুটি সম্মান আর সম্মানী। সম্মান তাঁদের অন্তরকে পরিতৃপ্ত করে, আর সম্মানী দিয়ে তাঁরা কোনোভাবে জীবন যাপন করেন। অথচ সময়ের পরিক্রমায় দুটির কোনোটিই যথেষ্ট নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে অপমান, অভাব আর বেদনাই তাঁদের সম্বল হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু নিশ্চয় এমন কিছুর স্বপ্ন দেখেননি। শিক্ষকরা বেতন ছাড়া আর তেমন কিছুই পান না, যেখানে সরকারি চাকুরেদের বেতনের বাইরে সুযোগ-সুবিধার তালিকা অনেক দীর্ঘ। আর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যে বেতন তাতে সম্মান বজায় রাখা তো অনেক দূরের, জীবন বাঁচানোও কঠিন। যদি সম্মানের কথা বলা হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের রাষ্ট্রীয় সম্মানের কথা ভাবলেই অন্যদের বিষয়টি বোঝা যায়।

শিক্ষকদের দুর্নীতি নিয়ে অনেক কথা হয়। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং সোশ্যাল প্যাথলজিক্যাল পরিস্থিতি এবং লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির প্রভাবমাত্র। শুধু শিক্ষায় নয়, সমাজের প্রায় সব ক্ষেত্রে ব্রিটিশ শাসনামলের মতো একটা মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে, যারা ‘ডিভাইড ও রুল’ নীতির মাধ্যমে নিজেরা সুবিধাভোগী হচ্ছে আর সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে।

সমাজে যারা শীর্ষ দুর্নীতিবাজ তাদের কয়জন শিক্ষক? কয়জন শিক্ষক কোটি টাকার সরকারি গাড়ি ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করেন? কয়জন শিক্ষক মালয়েশিয়া বা কানাডায় বাড়ি করেছেন? কয়জন শিক্ষক রাজউকের প্লট পান? শিক্ষকরা জাতির আদর্শ, সে হিসেবে তাঁদের আচরণ অনুসরণীয় হতে হবে; কিন্তু তাঁদের উপোস রেখে আদর্শের প্রত্যাশা কি যৌক্তিক? আমরা শুধু সমাজের উপরি কাঠামো দিয়ে শিক্ষকদের বিচার করছি; কিন্তু মূল কাঠামোতে শিক্ষকদের অবস্থান ও বৈষম্যের দিকগুলো মোটেও ভাবি না। বিলাসিতা নয়, সম্মানের সঙ্গে জীবন যাপনের জন্য শিক্ষকদের মানসম্মত বেতন ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয় কি? একই যোগ্যতাসম্পন্ন একজন যখন অন্য পেশায় থেকে অনেক কিছু ভোগ করেন, তখন কি শিক্ষকদের খারাপ লাগবে না? রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে ভারসাম্য বজায় রাখা, বৈষম্য তৈরি নয়, যা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অংশ। পৃথিবীর অনেক দেশে শিক্ষকদের বেতন আলাদা, সম্মান সর্বোচ্চ, এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতেও তাই। বেতন ও সুযোগ-সুবিধার বৈষম্য এত প্রকট যে আগামী দিনে শিক্ষকতায় মেধাবীদের অংশগ্রহণ কমবে বলেই মনে হয়।

যদি সত্যিকার অর্থে তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা তৈরি করতে চাই, তাহলে শিক্ষা ও শিক্ষকের অমর্যাদা করে সেটা কতটা সম্ভব, তা ভেবে দেখবেন। শিক্ষকদের পৃথক বেতনকাঠামোর দাবি অনেক দিনের, বরং অনেক কারণেই তা হচ্ছে না। ঘৃণ্যতম ১৫ই আগস্ট না হলে এত দিনে বঙ্গবন্ধু সেটা করতেন বলেই আমার বিশ্বাস।

মহামানবের জন্মশতবার্ষিকীতে শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতনকাঠামো প্রণয়ন করা হবে এবং তাদের মর্যাদার বিষয়টি নতুন করে ভাবা হবে, এই প্রত্যাশা করি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ৩০ হাজার টাকা ধরে অন্যদেরটা সে অনুপাতে করা যেতে পারে। বাংলাদেশ এখন আর গরিব দেশ নয়, যে দেশ নিজের টাকায় পদ্মা সেতু তৈরি করতে পারে, সে দেশ শিক্ষকদের পৃথক ও সম্মানজনক বেতনকাঠামোও তৈরি করতে পারবে। আমাদের ভরসার জায়গা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, যিনি শুধু বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা নন, একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মতো শিক্ষকদরদিও। যদি তা করা যায়, তাহলে দেশের শিক্ষা খাতের গুণগত পরিবর্তন আসবেই। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নও পূর্ণতা পাবে।

লেখক : শিক্ষক ও গবেষক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও  প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।